31 December 2017

পবিত্র মক্কা শরীফে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হয় যেভাবে


ধর্মীয় ডেস্কঃ পবিত্র কুরআন শরীফ ও হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমানিত এবং ইতিহাস সাক্ষী, যে ইসলামই সর্বপ্রথম মূর্খতা, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বরং সব অধিকার ও কর্তব্য ছাপিয়ে পবিত্র দ্বীন ইসলাম-ই শিক্ষাকে সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম কর্তব্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

বিশ্বমানবতার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত ইসলামের প্রথম বাণীই ছিলো এমনঃ পড়ুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত; যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান দান করেছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানত না। (পবিত্র সূরাঃ আলাক শরীফ, আয়াত শরীফ ১-৫)

পড়ার নির্দেশনা নিয়ে প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়। এরপর পবিত্র সূরা মুদ্দাসসির ও সূরা আদ-দোহা শরীফ অবতীর্ণ হলে রাসূলে খোঁদা হাবিবুল্লাহ হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পুরোদমে তাওহীদ ও রিসালতের প্রচার শুরু করেন। সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সহধর্মিনী হজরত খাদিজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি দ্বীন ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। [ইবনে ইসহাক, সীরাতে রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, বাতায়ন প্রকাশন, পৃষ্ঠা ১৩৭]

এরপর নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার নিকটতম আত্মীয়দের সতর্ক করে দিন। (সূরা শুআরা শরীফ, আয়াত শরিফঃ ২১৪)
এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকটতম ও বিশ্বাসযোগ্য লোকদের কাছে নবুয়তের কথা প্রকাশ করতে শুরু করেন। উনার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে প্রথমবারেই লাব্বাইকবলেছেন কয়েকজন আপনজন।

হজরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম, হজরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, জায়েদ ইবনে হারেসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, উসমান ইবনে আফফান যুন্নুরাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, জুবাইর ইবনে আওয়াম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, আবদুর রহমান ইবনে আউফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ মোট আট জন। পরে আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও আরকাম ইবনে আবুল আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ প্রথম তিন মাসে মোট ৪০ জন মতান্তরে ৪১ জন পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন। (ইবনে হিশাম, সীরাতে ইবনে হিশাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পৃষ্ঠা ৫৯)।

এর পর মাত্র তিন বছর সময়ে একশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে  বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।

সম্মানিত নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে ১১ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। উনাদের মধ্যে হজরত উসমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও ছিলেন। এটাই ইসলামের প্রথম হিজরত। উনাদের অনেকে মক্কায় পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার খবর শুনে ফেরত এসেছিলেন। পরে যখন দেখা গেল খবরটি অসত্য, তখন নবুয়তের সপ্তম বছর জাফর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নেতৃত্বে প্রায় ৮৬ জন পুরুষ ও ১৭ জন নারী সাহাবা দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরত। পরে উনারা সপ্তম হিজরিতে সেখান থেকে মদিনা শরীফে হাজির হয়েছিলেন।

ইবনে ইসহাক রহমতুল্লাহী আলাইহির বর্ণনা মতে, আবিসিনিয়ায় ইসলামের প্রথম হিজরতকারীদের সংখ্যা ছিল ৮৩ জন। আর রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা শরীফ থেকে মদিনা শরীফে হিজরতকালে আনুমানিক পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন।

এই নওমুসলিমরা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল উনাদের জন্য পবিত্র দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানার ও শেখার ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী দলকে নিয়ে দারুল আরকামেসর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। এটি ছিল নওমুসলিম আরকাম ইবনে আবুল আরকামের বাড়ি। এ বাড়িতে হাবিবুল্লাহ হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র দ্বীন ইসলামের দাওয়াতের কাজ করতেন। পাশাপাশি সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমানদের মধ্যে কোরআন শরীফ, নামাজ ও নৈতিকতা শিক্ষা দিতেন। এটাই ছিল পবিত্র দ্বীন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র।

তবে আরো একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, হজরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণের পর উনার গৃহে দারুল আরকামেরআগে ইসলামের প্রথম উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করেছিলেন। সেখানে নামাজের প্রশিক্ষণ হতো, কোরআনের তেলাওয়াত হতো। (ড. আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব, ইফা, পৃষ্ঠা ৪৩)

পরে সেটি মসজিদে আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এ রূপ নেয়। সহিহ বুখারি শরিফের কিতাবুল কাফালায় বর্ণিত হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়, মসজিদে আবু বকরে কোনো মুয়াল্লিম বা শিক্ষক ছিলেন না। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেই সেখানে তালিমের কাজ আঞ্জাম দিতেন। এখানে অমুসলিম ছেলে-মেয়েরাও কুরআন শরীফের তেলাওয়াত শুনত।

ইবনে হিশাম হজরত ওমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-কে উদ্ধৃত করে বলেন, খাত্তাবের কন্যা ও ওমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বোন ফাতেমা ও উনার স্বামী সাঈদ বিন জায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণের পর উনার নিজ গৃহে একটি ইসলামী উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ইবনে আবত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নামের একজন সাহাবি নওমুসলিমদের কুরআন শরীফ শিক্ষা দিতেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমানিত হলো, রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মক্কা শরীফের জীবনে ইসলামী শিক্ষার বিকাশ হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় ছিল ব্যক্তিগত। এ সময় রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। আর যারা উনার দাওয়াতে সাড়া দিতেন, তিনি উনাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। দ্বিতীয় পর্যায় ছিল গৃহে অথবা আঙ্গিনায় মসজিদ বা মক্তব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেমন-আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও ওমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বোন ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর গৃহে প্রতিষ্ঠিত মক্তব। তৃতীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাফা-মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তত্ত্বাবধানে দারুল আরকামে

মক্কাশরীফ কেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার এই ধারা কালক্রমে মদিনা শরীফে স্থানান্তরিত হয়। হিজরতের আগেই এই স্রোত মদিনা শরীফের অলিগলিতে প্রবাহিত হয়। সুবহানাল্লাহ!!!


শেয়ার করুন

0 facebook: