মুফতি
মাহমুদ হাসানঃ ওয়াজ-নসিহত বা উপদেশ মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ
একটি অংশ। এটি মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের অতুলনীয় পন্থা।
ইসলামের
শুরু থেকেই এর পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে। এমনকি ইসলামের পূর্ব যুগেও যুগে যুগে
মনীষী ও পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে জনসাধারণের প্রতি ওয়াজ-নসিহতের বিষয়টি পাওয়া যায়। কোরআন
শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর
স্মরণ করো ওই সময়ের কথা,
যখন লোকমান আলাইহি ওয়াছাল্লাম তার পুত্রকে ওয়াজ (উপদেশ) করতে গিয়ে
বলল, হে
পুত্র আমার! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না, নিঃসন্দেহে শিরক মহা অপরাধ। ’ (সুরা
: লোকমান, আয়াত
: ১৩)
ওয়াজ
ও নসিহতের এ কল্যাণধারা রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাহাবায়ে
কেরাম, তাবেঈন
ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত উম্মতের আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত
রয়েছে। যদিও যুগ, স্বভাব
ও পরিবেশের পরিবর্তনে এতে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান অবধি তা
অব্যাহত আছে এবং থাকাও অপরিহার্য। বর্তমানে তাতে কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও এর মৌলিক গুরুত্ব
ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বর্তমানে ওলামায়ে কেরাম ও দ্বিনি ভাইয়েরা যদি কিছু বিচ্যুতির
সংশোধনের প্রতি খেয়াল করেন,
তাহলে এর উপকারিতা আরো বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে।
ওয়ায়েজ
বা বক্তা নির্বাচন
অবশ্যই
সতর্ক হতে হবে যে বক্তা যেন হক্কানি আলেম তথা দ্বিনের সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন ও মুত্তাকি
হয়ে থাকেন।
অযোগ্য
ব্যক্তির হাতে ইসলামের কাজ সোপর্দ করা রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
-এর বাণী অনুসারে কিয়ামতের নিদর্শন। ইসলামী আইনবিষয়ক বিশ্বকোষ ‘আল মাওসুআতুল
ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’
নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘ওয়ায়েজ
হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত আছে। এক. ওয়ায়েজ ব্যক্তি বিবেকবান ও বালেগ হওয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ
হওয়া। তিন. হাদিস শরীফের শব্দ,
অর্থ,
ব্যাখ্যা,
বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা। চার. কোরআন শরীফ
তাফসিরকারক হওয়া। কোরআন শরীফ কঠিন থেকে কঠিন বিষয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকা।
আগের তাফসিরবিদদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা। ’ (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যা :
৪৪/৮১)
‘এলাকার লোক’, ‘সুললিত
কণ্ঠের অধিকারী’, রেডিও-টিভির
ভাষ্যকার’ ইত্যাদি
বক্তা নির্বাচনের শরয়ি মানদণ্ড নয়। তবে হ্যাঁ, হক্কানি আলেম হওয়ার পাশাপাশি এসব গুণ কারো
মধ্যে থাকলে তাঁদের আমন্ত্রণ জানাতে কোনো অসুবিধা নেই। (আলমাউসুয়াতুল ফিকহিয়া : ৪৪/৮১, ফাতাওয়ায়ে
রহিমিয়া : ২/৩৬৭)
ওয়াজের
বিষয়
ওয়াজ
যেন দ্বিন ও শরিয়তের বিভিন্ন শাখা থেকে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হয়ে থাকে। অপ্রয়োজনীয়
ও বেহুদা হাসি-মজায় যেন সময় নষ্ট না হয়। হাদিস শরীফে এসেছে, ‘ব্যক্তির
(জীবনে) ইসলামের সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। ’ (তিরমিজি, হাদিস
২৩১৭)
জাল হাদিস
শরীফ ও জাল কাহিনিমুক্ত হওয়া
কোরআন
শরীফ, তাফসির, গ্রহণযোগ্য
হাদিস শরীফ এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের বাণী এবং সত্য ও শিক্ষণীয়
ঘটনাবলির আলোকেই ওয়াজ করা অপরিহার্য। জাল হাদিস শরীফ ও অসত্য কাহিনি বর্ণনা করা থেকে
অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। যাচাই করা ছাড়া যেকোনো বই থেকে কোনো কথা বা ঘটনা পেয়েই বয়ান
শুরু করবে না। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমদের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবে। জেনেশুনে
উপদেশস্বরূপ জাল হাদিস শরীফ বর্ণনা করা কবিরা গুনাহ। হাদিস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি
জেনেশুনে আমার নামে কোনো মিথ্যা হাদিস শরীফ বর্ণনা করে, সে মিথ্যাবাদীদের
একজন। ’ (তিরমিজি, হাদিস
: ২৬৬২) অন্য হাদিস শরীফে এসেছে,
‘যে ব্যক্তি আমি যা বলিনি, এমন কথা আমার পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত বর্ণনা
করে, সে
যেন জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নেয়। (বুখারি, হাদিস শরীফ : ১০৭)
অপব্যয়মুক্ত
হওয়া
ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্যসহ
অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচে মধ্যপন্থা কাম্য। অপব্যয় থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। মহান আল্লাহ
বলেন, ‘আর
তোমাদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে না। জেনে রেখো, যারা
অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই,
আর শয়তান নিজ প্রতিপালকের ঘোর অকৃতজ্ঞ। ’ (সুরা
: বনি ইসরাইল, আয়াত
: ২৬-২৭)
মাইক
ব্যবহারে সতর্কতা
সভাস্থলে
প্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার কাম্য। দূর-দূরান্তে ও বাজার-ঘাটে অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে
উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। এতে শরিয়তবিরোধী অনেক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়, যেমন
- নামাজির নামাজে ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত হয়, অসুস্থ
ব্যক্তির কষ্ট হয় এবং বিভিন্ন বৈধ কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাজে ব্যাঘাত হয়। আলেমরা মানুষের
ঘুমে ব্যাঘাত হয়, এমন
জোরে কোরআন তেলাওয়াতও অবৈধ বলেছেন। (ফাতহুল কদির ১/২৯৮, ফাতাওয়ায়ে
মাহমুদিয়া ৩/৫৫২, জিকর
ও ফিকির, পৃষ্ঠা
২৬)
হজরত
ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট
আওয়াজে ওয়াজ শুরু করে, এতে
পাশেই হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু -এর কাজে ব্যাঘাত হতো, তাই তিনি
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু -কে বিষয়টি অবহিত করলে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে ওমর রাদিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু এসে তাকে শাস্তি দেন। (আখবারু মাদিনা : ১/১৫)
গভীর
রাত না হওয়া
গভীর
রাত পর্যন্ত ওয়াজ হলে সাধারণ মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হওয়াসহ পরদিন ফজরের নামাজে ব্যাঘাত
হবে, তাই
গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ না হওয়াই কাম্য। এ বিষয়ে রদ্দুল মুহতার নামক কিতাবে এসেছে :
‘এশার
নামাজের আগে ঘুমানো এবং এর পরে কথা বলা হাদিস শরীফে নিষেধ করা হয়েছে। অন্য হাদিসে বর্ণিত
হয়েছে, এশার
পর কোনো কাজ নেই। কিন্তু মুসল্লির জন্য নামাজ আদায় আর মুসাফিরের জন্য সফর করা বৈধ।
’ (রদ্দুল
মুহতার : ১/৩৬৮)
বক্তাকে
ওয়াজের হাদিয়া দেওয়ার বিধান
আগের
যুগে আলেমদের ভরণ-পোষণ ছিল রাষ্ট্রের অধীনে। সে সময় তাঁদের জন্য অন্যের থেকে অর্থ গ্রহণ
বৈধ ছিল না। পরবর্তী যুগের ইসলামী পণ্ডিতরা কিছু কিছু দ্বিনি কাজের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া
জায়েজ বলেছেন। অনেক আলেম ওয়াজকেও ওই সব কাজের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু ‘এত টাকা
দিতে হবে, অন্যথায়
ওয়াজ করব না’-এভাবে
বলা উচিৎ নয়। তবে হ্যাঁ,
এ অবস্থায়ও টাকা নেওয়া অবৈধ হবে না। এ বিষয়ে ‘দুররুল
মুখতার’ নামক
কিতাবে এসেছে : ‘বর্তমানে
কোরআন শরীফে শেখানো, ফিকাহচর্চা, ইমামতি, আজান
ইত্যাদির বিনিময় গ্রহণের ব্যাপারে বৈধতার ফতোয়া দেওয়া হয়। কেউ কেউ আজান, ইকামত
ও ওয়াজকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ’
(আদ দুররুল মুখতার : ৬/৫৫)
ওয়াজ-নসিহতের
মাধ্যমে সমাজের দ্বিনি প্রয়োজন পুরা করাও ইসলামের একটি জরুরি শাখা। তাই যদি কেউ ওয়াজের
জন্য নিজেকে ফারেক রাখে,
তার জন্য ওয়াজের পারিশ্রমিক গ্রহণ বৈধ হবে, চাই চুক্তি
করে হোক বা পূর্বচুক্তিবিহীন। তবে উত্তম হলো, এভাবে চুক্তি করে টাকা ধার্য না করা। (রদ্দুল
মুহতার : ৬/৫৫, ইমদাদুল
ফাতাওয়া : ৩/৩৮৯)
কিন্তু
নিয়মতান্ত্রিক দায়িত্ব ছাড়া হঠাৎ কাউকে বয়ানের জন্য বলার পর পারিশ্রমিক চাওয়া বৈধ নয়, যেমন
মসজিদে নামাজ পড়ানোর জন্য যদি কেউ ইমাম নিযুক্ত হয়, যে নামাজ পড়ানোর জন্য নিজের সময়কে খালি করে
রাখে, ওই
ব্যক্তির জন্য ইমামতির পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ। কিন্তু দায়িত্বে নিয়োগবিহীন নামাজ শুরু
হওয়ার প্রাক্কালে একজনকে নামাজ পড়াতে বললে ওই ব্যক্তি নামাজ পড়ানোর কারণে পারিশ্রমিক
নেওয়া জায়েজ হবে না। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৩৮৯, আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৩০০)
অতিরিক্ত
বিনিময়ের চাহিদা
বিনিময়
বৈধ হলেও এটা নিছক কোনো পণ্য বিক্রির মূল্যের মতো নয়। তাই তা নিয়ে দর-কষাকষি বা বেশি
চাহিদা পেশ করা ঠিক নয়। পণ্য কেনাবেচার মতো দরদাম করে, অগ্রিম
বুকিং মানি নেওয়া ওলামায়ে কেরামের শান, মান ও ইজ্জতের সঙ্গে মানানসই নয়, এতে দ্বিনের
অসম্মান হয়, তাই
তা মাকরুহে তাহরিমি তথা নাজায়েজ হবে। (কিফায়াতুল মুফতি : ৭/৩১৯, ৩৩০, আহসানুল
ফাতাওয়া : ৭/২৮০)
বিনিময়
নিলে সওয়াব হবে?
যদি দ্বিনের
খেদমতের নিয়তে ওয়াজ করে,
প্রয়োজনের কারণে বিনিময় নিয়ে থাকে, তাহলে
ওয়াজের সওয়াব পাবে। আর যদি শুধু টাকার জন্যই এ পেশা গ্রহণ করে, তাহলে
সওয়াব পাবে না। তাই বিনিময় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, কম দিলে এ কারণে পরবর্তী বছর দাওয়াত গ্রহণ
না করা এবং দুই স্থানের যেখানে টাকা বেশি দেওয়া হয় তা গ্রহণ করা ইত্যাদি কারণেও সওয়াব
পাবে না। তবে প্রত্যেকের নিয়ত তার অন্তরের বিষয়, তাই কারো নিয়তের ওপর আঘাত করার অধিকার কারো
নেই। তাই কোনো বক্তাকে নিয়তের ব্যাপারে আঘাত করা যাবে না। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৩৪০
লেখক
: ফতোয়া গবেষক ও মুহাদ্দিস
খবর বিভাগঃ
ধর্ম ও জীবন
0 facebook: