সিরাজুল ইসলামঃ মাঠে নামতে পারে জামায়াত তাই ডিবিও আছে সতর্ক অবস্থানে। এদিকে নাশকতার আশঙ্কায় সতর্ক পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত, আবাসিক হোটেলে নজরদারি, বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতাকেও খোঁজা হচ্ছে, চোরাগোপ্তা হামলাও হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ৮ ফেব্রুয়ারি। এ রায় নিয়ে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করছে পুলিশ। তারা বলছে, ওইদিন বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাও মাঠে নামতে পারে। আর গোয়েন্দারা দাবি করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ওই দিন চোরাগোপ্তা হামলা হতে পারে বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এর ভিত্তিতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে তারা। ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে’ সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোয়ও।
বিগত ৪ দিনে বিএনপির ৩০০+ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি। এর মধ্যে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাও। বিএনপি বলছে, আতঙ্ক ছড়াতে ও দলকে দমিয়ে রাখতে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসব উপেক্ষা করে ৮ ফেব্রুয়ারিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমেই রাজপথে থাকতে চান তারা।
পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মনিরুজ্জামান শুক্রবার বিকালে প্রতিবেদককে বলেন, ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীরা নাশকতার মহড়া চালিয়েছে। ওই দিন প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে দুই নেতাকর্মীকে ছিনিয়ে নেয় তারা। তাই ৮ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে পুলিশের সব ইউনিটকে কঠোর অবস্থানে থাকতে পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নবনিযুক্ত আইজি ড. মুহম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এরই মধ্যে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গোয়েন্দা বিভাগ এবং বিভিন্ন জেলার এসপিদের কাছে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছেন।
মনিরুজ্জামান আরও বলেন, যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ কঠোর অবস্থানে আছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে বড় ধরনের পরিকল্পনা দিয়ে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মীরা মাঠে নামতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, বাইরে থেকে বিএনপি যাতে লোকজন আনতে না পারে, সে জন্য রাজধানীর প্রবেশপথে পাহারা (চেকপোস্ট) বসানো হবে। পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। আবাসিক হোটেলগুলোয় অতিথিদের অবস্থানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে।
৩০ জানুয়ারি ঘটনার পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর তিন (রমনা, শাহবাগ ও পল্টন) থানা ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছেন ডিবি দক্ষিণের উপকমিশনার মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন, এসব নেতাকর্মীকে রমনা ও শাহবাগ থানার তিন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিনই ডিবির অন্যান্য বিভাগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে দক্ষিণ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবারও বিএনপির থানা পর্যায়ের তিন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, ৮ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা নাশকতার পরিকল্পনা করছে। তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি আমরা। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চলছে। কেউ যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সে জন্যে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দফতরে আইজিপির সঙ্গে বৈঠকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের অপচেষ্টা রুখে দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে আইজিপি বিশেষ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, ৩০ জানুয়ারির ঘটনায় ইন্ধন দেয়ার অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এখন কারাগারে আছেন। আজিজুল বারী হেলাল রিমান্ডে আছেন। আরও কয়েকজন কেন্দ্র্রীয় নেতাকে খোঁজা হচ্ছে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন-অর রশিদ বলেন, পুলিশ সদর দফতরে বুধবারের বৈঠকে আমি থাকতে পারিনি। তবে আইজিপির মেসেজ আমি পেয়েছি। সে অনুয়ায়ী পরিকল্পনা করছি। এরই মধ্যে অভিযান শুরু করেছি। আজও (বৃহস্পতিবার) মোশাররফ হোসেন নামে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করেছি। এসপি হারুন বলেন, যারাই নাশকতার চেষ্টা করবে, আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। আন্দোলনের নামে যারা জ্বালাও-পোড়াও করবে, গাজীপুরকে যারা আশান্ত করার চেষ্টা কবরে বা মানুষকে আঘাত দেবে, তাদের স্থান হবে কারাগার।
পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হক জানান, বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে বিএনপির ৯ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুক্রবার তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। ওই নয়জনসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৪০-৪৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে বৃহস্পতিবার একটি মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাভার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র রিফাত উল্লাহও আছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের বৃহস্পতিবারই আদালতে পাঠানো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পল্টন ও ফকিরাপুল এলাকার হোটেলগুলোয় এরই মধ্যে নজরদারি বাড়িয়েছি। হোটেলগুলোয় যারা বুকিং দিচ্ছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
পল্টন থানার এসআই অলিউর রহমান বলেন, গ্রেফতার বিএনপি নেতাকর্মীদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলায় আরও যাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে তাদের মধ্যে আছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, যুবদল সভাপতি সাইফুল ইসলাম নীরব, যুবদল সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম মজনু, ছাত্রদল সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য হাবিবুর রশীদ হাবিব, ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান প্রমুখ।
শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, ৩০ জানুয়ারির ঘটনার পর শাহবাগ থানা পুলিশ এ পর্যন্ত ৩৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। রমনা থানার ওসি মাইনুল ইসলাম জানান, ৩০ জানুয়ারির পর থেকে রমনা থানা পুলিশ ৫৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। ২২ জন রিমান্ডে আছে। তবে মামলাটি এখন ডিবি তদন্ত করছে।
রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। হোটেল নিউইয়র্কের রিসিপশন ম্যানেজার রেহেনা আক্তার সুমি, হোটেল আসরের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর শরীফ এবং হোটেল পারাবতের ম্যানেজার বেলাল হোসেনসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি ঘিরে এখনও সেভাবে কেউ বুকিং দেয়া শুরু করেনি। তবে হোটেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। বোর্ডার তুলতে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপিঃ দলের নেতারা বলছেন, রায় ঘিরে কোনো সহিংস কর্মসূচিতে তারা যাবেন না। তেমন কোনো পরিকল্পনাও নেই। তারপরও রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করেছে। চার দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের দুই ছেলেসহ রাজধানী থেকেই পুলিশ ২৭৫ নেতাকর্মীকে আটক করেছে।
বুধবার রাতে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ের গেট থেকে সুমিতকে ধরে নেয়া হয়। তিনি তার ছোট ভাই অমিতের জন্য ওষুধ ও গরম কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন। মঙ্গলবার রাতে শান্তিনগরের বাসা থেকে তার ছোট ভাই বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে আটক করে পুলিশ।
শুক্রবার নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী জানান, বৃহস্পতিবার ৩৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিন বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক কাজী রওনকুল ইসলাম টিপুকে শাহবাগ এলাকা থেকে উঠিয়ে নিয়েছে র্যাব। গ্রেফতার নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মশিউর রহমান বিপ্লব, চকবাজার থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম রাসেল, শাহবাগ থানা বিএনপি নেতা মো. খলিল, মতিঝিল থানা বিএনপি নেতা রানী বাবু, খিলগাঁও থানা বিএনপি নেতা আমির সর্দার, রূপনগর থানা বিএনপি নেতা মো. মুক্তার হোসেন, উত্তরা পশ্চিম থানা বিএনপি নেতা রহমত উল্লাহ দুলাল, দারুস সালাম থানা বিএনপি নেতা জাকির হোসেন সজীব, শেরেবাংলা নগর থানা বিএনপি নেতা আলমগীর, পল্লবী থানা মহিলা দল নেত্রী সৈয়দ দিলারা কলি ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের ৭০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারসহ অনেক নেতার বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মুন্সি বজলুল বাসিত আঞ্জু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহসভাপতি মীর হোসেন মীরু, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেল্লাল চেয়ারম্যান, দারুসসালাম থানা বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির, দারুসসালাম থানা শাখা মহিলা দলের সভানেত্রী নাজমা কবির এবং শ্যামপুর থানা বিএনপি নেতা আ ন ম সাইফুলের বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, নিতাই রায় চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান, নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিক সিকদার, যুবদল নেতা কাজী আজিজুল হাকিম আরজুর বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায় বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
0 facebook: