28 December 2017

খ্যাতির যেমন কদর আছে, তেমনি বিড়ম্বনাও আছেঃ অর্বাচীন

স্কুলে নতুন ছাত্র হিসাবে পরিচিতি পেতে অনেক সময় লাগে। যদি দ্বিতীয় দিনে পুরো স্কুলের সবাই চিনে ফেলে তাহলে সেটা খুব আশ্চর্য্য ঘটনাই বটে। ফুটবল খেলার গোলকিপার হয়ে আমার পরিচিতিটা দ্বিতীয় দিনেই সকল ছাত্র শিক্ষকের নিকট সমান হারে পরিচিতি লাভ করাটা আমার জন্য আশ্চর্য ঘটনাতো বটেই। স্যারেরা দুর থেকে দেখেই ডেকে কাছে এনে নানান উপদেশ দেন। ক্লাশ টেনের ভাইয়ারাও ভালোবাসেন। নিচের ক্লাশের সবাই বেশ সমীহ করে। বিষয়টা প্রথম দিকে বেশ আনন্দময় ছিল।

এই খ্যাতির কারনে অল্প কারনেই বিড়ম্বনার শিকার হতে লাগলাম কিছু দিন পরেই। প্রায়শই বিভিন্ন গ্রাম থেকে গোলকিপার হিসাবে ক্ষেপ খেলার প্রস্তাব আসে। এটা ছিল আমার জন্য এক মহা বিব্রতকর বিষয়। শুধু মাত্র আমিই জানি যে আমি ভালো গোল কিপার নই। অথচ এলাকায় খবর ছড়িয়ে গেছে আমি এক দুর্দান্ত গোলকিপার। রতনের মত প্লেয়ারের প্যানালটি কিক আমি মাথা দিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারে।

রতন যদিও নিচের ক্লাশে পড়ে। কিন্তু সে বয়সে উচ্চতায় আমাদের সবার চেয়ে বড়। তার হাতে পায়ে যে কি পরিমান শক্তি মজুদ রাখে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ক্লাস সেভেনে সে আদু ভাই হতে চেয়েছিল। দুই বছর সে ক্লাশ সেভেনেই ছিল। সেবার হেড স্যার রাগ করে বলে দিয়েছেন, হয় সে ক্লাশ এইটে প্রমোশন নিবে নয়তো স্কুল ছাড়তে হবে। স্কুল ছাড়তে হবে এমন হুমকী পেয়ে সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে শুধু বই নিয়ে পড়েছিল। একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে হেড স্যার বরাবর দরখাস্ত লিখে, তাকে যেন স্যার একবারের জন্য হলেও দেখে যান। হেড স্যার সেদিন রতনকে দেখতে বাড়ি এসে তাকে প্রমোশন দেওয়ার আশ্বাস দেন।

যেহেতু আমি নিজে জানি আমি ভালো গোলকিপিং পারি না, তাই নানান বাহানা ধরে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন যতই ফিরিয়ে দেই ততই অনুরোধ বাড়তে থাকে। ক্ষেপ খেলায় আর্থিক লাভ যেমন থাকে তেমনি খেলায় হেরে গেলে অর্থের বদলে মাঝে মাঝে মাইরও জোটে। তাছাড়া বাবার চরম নিষেধাগ্গাতো আছেই। অবশেষে হেড স্যারের দোহাই দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম। এলাকার লোকেরা বাপ মায়ের চেয়েও হেড স্যারকে বেশী মান্য করেন।

এখন সমস্যা শুরু হয়েছে স্কুলে। ক্লাশে পড়া না পারলে অন্যদের হালকা বকে ছেড়ে দিলেও আমার বিষয়ে কোন ছাড় নাই। কারনে অকারনে ফুটবলের গোলকিপার প্রসংগ তুলে খোঁচা দিয়ে বকা দেন স্যারেরা। কথায় কথায় বলেন, "শুধু ফুটবল ভাল খেললেই কি পাশ মিলবে? পাশ করতে হলে পড়তে হবে।" পড়া না পারার জন্য অন্যরা যেখানে একটা বকা শুনে, আমাকে সেখানে দুইটা বা তার অধিক বকা শুনতে হয়।

ধর্ম বিষয়ের হুজুরতো দুই ডিগ্রী বেশী। এই স্কুলে তিনিই একমাত্র শিক্ষক যিনি ক্লাশ টেনের ছাত্রদেরকেও বেত দিয়ে পিটুনী দেন। এই ক্ষমতা নাকি তিনি তার পিতার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছেন। তাহার পিতাও এই স্কুলের ধর্ম শিক্ষক ছিলেন। আর তাহার পিতা আমার আব্বার একজন শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। আমার আব্বাও এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। একারনেও নাকি আমাকে বকা দেওয়া এবং বেত্রাঘাত করা সকল শিক্ষকগন নৈতিক দায়িত্ব হিসাবে নিয়েছিলেন।

বাংলা পড়াতেন জাহের স্যার। তিনি যত না মারিতেন হাতে, তার চেয়ে অধিক মারিতেন ঠোটে। পড়া না পারলেই তিনি বলতেন, বাপের নাম বেইচা তো পাশ করা যাবে না। পরীক্ষার হলে ফুটবলও যাবে না, বাপও যাবে না। প্রসংগত বলে রাখি আমার আব্বা একটা বেসরকারী কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। জাহের স্যার একথাটা আমায় বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার মহান দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান।। তার ধারনা, আমি ফুটবল খেলায় এমন মসগুল যে একেবারে বাপের নামও ভুলে গেছি। অথচ আমি আগেও তেমন ফুটবল খেলি নাই। আর সেদিনের পর খেলার কোন অবকাশই পাই নি। ওফ্! কেন যে সেদিন ফুটবল খেলতে গেছিলাম। না খেললে আজ জাহের স্যার এমন কথা বলতে পারতেন না।

রফিক স্যার তো আমার "দুইটা খাসী কোরবানী করে রাখা" নামটাই পাল্টে দিলেন। পথে ঘাটে হাটে বাজারে ক্লাশে যেখানেই দেখা হউক না কেন। "এই যে গোলকিপার, কি খবর" এই বলে পান খেয়ে লাল করা ঠোটে আকর্ণ হাসি দিয়ে ডাক দিয়ে বসেন। এই ডাকে যে কত স্নেহ মিশানো ছিল তখন তা বুঝি নাই। তখন এই ডাক যেন শুনতে না হয় এজন্য যতটুকু সম্ভব স্যারকে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সকল প্রকার চেস্টা করতাম।

গ্রামের স্কুল। পায়ে চলা মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে আশে পাশের গ্রাম থেকে ফসলি জমির আইল ধরে স্কুলে আসা যাওয়া করতে হয়। ভরা বর্ষা কালে নৌকা করে আসতে হয়। বর্ষার আগে ও পড়ে যখন নৌকা চলে না তখন এক হাটু সমান কাঁদা মারিয়ে আসা যাওয়া করি। স্কুলে এসে পুকুর ঘাটে নেমে হাত পা ধুয়ে তো ক্লাশে প্রবেশ করতাম। আসা যাওয়াতেই বেশ সময় ব্যয় হতো। স্কুলে কয়েকজন হিন্দু ছাত্র ছিল। তারা প্রায়শই বলতো, আমরা যে কস্ট করে স্কুলে আসা যাওয়া করি তা দেখে বিদ্যাদেবী স্বরসতী যদি আমাদের প্রতি সদয় না হন তাহলে তার দেবীত্ব দাবী অন্যায় হবে।

স্কুলে কোন অনুস্ঠান হলে ছাত্রছাত্রীদের কোন স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন দেখি না। টিচারগন যাদেরকে যোগ্য মনে করতেন তাদের জোর করে অংশ গ্রহন করতে বাধ্য করতেন। কবিতা আবৃতি করতে গেলে উচ্চারন যা হতো তা আজ মনে হলেই হাসি পায়। আমাদের এলাকায় "হ" কে "অ" "ভ" কে "ব" উচ্চারন করে। বাড়িতে মায়েদের অপছন্দনীয় কোন কাজ করলে মায়েরা কাঠি বা ঝাটা হাতে মারতে আসতেন। আমরা দৌড়ে পালাতাম। মা তো আর আমাদের সাথে দৌড়ে পারতেন না। আমাদের ধরতে না পেরে মা রেগে গিয়ে বলতেন, "আজ তর হাওয়া বন্ধ। যারে মারাম আতে, তারে মারাম বাতে"। অর্থাৎ," আজ তোর খাওয়া বন্ধ। যাকে মারবো হাতে, তাকে মারবো ভাতে।" তাছাড়া কিছু শব্দ এমন যে তার বানান এক উচ্চারন আরেক। যেমন ব ইকার ড় আকার ল উচ্চারন হতো মেকুর। চট্টগ্রামের লোকেরা যেমন ম ওকার র গকে মোরগ না বলে কুরা বলে।

কবিতা আবৃতিতে এমন উচ্চারন তো কবিরা গোনাহ। কিন্তু আমরা তা থেকে কিছুতেই উন্নতি করতে পারি নাই। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, এই স্কুলে আবৃতির বিষয়ে আমিই একটু একটু ঝাপসা দেখি। আর বাকি সকলেই কানা। যদিও আমার উচ্চারনও প্রায় তাদের সম মানের। তবে আশার কথা এই যে, যে বনে বাঘ নাই, সে বনে শিয়ালই রাজা। আমারও হয়েছে তাই।

একবার কবিতা আবৃতি প্রতিযোগিতায় আমাকে মোটামোটি জোর করেই অংশ গ্রহন করানো হল। আমি কবি জসিম উদ্দিনের কবর কবিতা আবৃতি করি। আমি পড়েছিলাম, "এইহানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে। তিরিশ বছর বিজায়ে রেহেছি দুই নয়নের জলে।" আরেকবার কবি নজরুলের মানুষ কবিতা আবৃতি করতে গিয়ে বলেছিলাম, পূজারী দোয়া হোল। হোদার ঠাখুর দাড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হল।" সেই দুই বারই আমিই প্রথম স্থান লাভ করি। কোন প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া যে কি আনন্দের তা যে প্রথম হয়েছে সেই অনুভব করতে পারে।

এই কবিতা আবৃতিই যে আমাকে আরেক বিরম্বনায় ফেলবে তা কে জানতো। ক্লাশ নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা আর মাত্র এক মাস বাকি। এমনি এক দিন ক্লাশ টেনের জীবন ভাই আমাকে টিফিন বিরতির সময় ডেকে পাঠালেন। আমি যেতেই বললেন, "তুমি সাহিত্য সম্পাদক।" আমি তাহার কথায় কিছুই বুঝলাম না। বললাম, "কি বললেন?" তিনি ধীর স্থীর ভাবে আমাকে বুঝিয়ে বললেন। "কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি আদেশ দিয়েছে। আমাদের স্কুলে একটা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করতে হবে। সেই সংগঠনের সভাপতি আমি আর তুমি হলে সাহিত্য সম্পাদক।"

আমি বললাম, "আমার কি করতে হবে? আর আমাকেই বা কেন এই দায়িত্ব দিচ্ছেন?" তিনি আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষন করে বললেন, " কাজ কি করতে হবে তা যথা সময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। আর আমি মনে করি সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে তুমিই যোগ্য। এখন যাও। যখন ডাকবো, সংগে সংগে চলে আসবা।"

জীবন ভাইকে দেখেছি, শান্ত শিস্ট নম্র স্বভাবের সদা হাস্য একজন ভাল ছাত্র। কিন্তু আজ তাহার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। আমায় কি করতে হবে? তাহার উদ্দশ্যটা কি? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি এলাম। আব্বাকে বিষয়টা জানালে তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, খবরদার, কখনোই ওমুখী হবে না। স্কুলে পড়তে গেছিস পড়বি। ক্লাশ শেষ হলে সোজা বাড়ি চলে আসবি।

আমি চাচ্ছিলাম না জীবন ভাইকে "না"বলি। কিন্তু আব্বাতো স্পস্ট বলে দিয়েছেন ওমুখো না হতে। কেমন করে জীবন ভাইকে একথা বলি। একথা ভাবতে ভাবতে বিভোর। কোন সমাধান পাচ্ছি না।

খোদা তো অন্তর্যামী, তিনি মনের খবর জানেন। সমস্যাটাও সুন্দর ভাবে সমাধান করে দেন। হটাৎ জীবন ভাইয়ের কি হলো বুঝা গেল না। তিনি কাওকে কিছু না বলেই গভীর পড়াশুনায় মন দিলেন। টেস্ট পরীক্ষা শেষ বিধায় স্কুলে আসাও বন্ধ করে দিলেন। তাকে ভাল ভাবে পাশ করতে হবে। তাই আমাকেও আর ডাকেননি। আর আমিও হাফ ছেড়ে বাচলাম।

ভাগ্যিস আব্বা আওয়ামীলীগের একজন অন্ধ ভক্ত হওয়া সত্ব্যেও আমাকে বারণ করেছিলেন। আর জীবন ভাইও ব্যস্ততার কারনে আমায় ডাকেন নি। নইলে এক সময় আমি ওমুক রাজনৈতিক দলের সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম বলে লোকেরা আমার প্রতি অংগুলি নির্দেশ করার সুযোগ পেতো। বর্তমান কালের রাজনৈতিক দলের যা চরিত্র, তা দেখে রাজনৈতিক দলের সদস্য না বলে ঐসব অপবাদ থেকে বেচে গেছি। ধন্যবাদ আমার মরহুম আব্বাকে, ধন্যবাদ জীবন ভাইয়ের এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিকে।

লেখকঃ অর্বাচীন।


শেয়ার করুন

0 facebook: