30 December 2017

দায়িত্ববোধ থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ফলাফল পাওয়া যায় যদিও তা কঠিন কাজ হয়

কলামিস্ট অর্বাচীনঃ ২০০৮ সাল। অপারেশন নবযাত্রা। জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরী প্রকল্প। শ্রীপুরের পর চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড এবং রাউজান উপজেলাকে নেওয়া হল পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল রাউজান উপজেলার চৌদ্দটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার সকল ভোটারদের জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরী করার কাজ। যদিও একাজে আমার কোন পুর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তবুও কেনো অধিনায়ক আমাকে এমন মহান দায়িত্ব দিলেন জানি না।

সেনা অফিসাররা হলেন গোল আলুর মত। সব তরকারীতেই ফিট হয়েযান। মাছ দিয়ে যেমন রান্না করা যায়, গোশত দিয়েও তেমন রান্না করা যায়। গরু মুরগী খাসী হাঁস, যেকোন গোশতের সাথেই সঠিক ভাবে মিলে যায়। তাছাড়া আলু ভাজি, আলু ভর্তা তো কমন ব্যপার। মেস কমান্ডার বাজারে সব্জি কিনতে পারে নাই। কোন সমস্যা নাই। গোল আলু আছে তো। সকালে নাস্তায় আলু ভাজি, দুপুরে আলু ভর্তা ও মাছের সাথে আলুর টুকরা। রাতে আলুর দম ও গোশতের সাথে আলুর টুকরা। তাছাড়া যদিও নাম তার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, তাও আলু দিয়েই হয়। আলু এক সার্বজনীন খাবার, সবার কাছেই সমান প্রিয় আর সেনা অফিসাররা হলেন সেই আলুর মতো।

তো বলতে ছিলাম রাউজান উপজেলার প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটারের ছবি তুলে জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরী করে দিতে হবে। আমার সাথে ৩০ জন সেনা সদস্য। তাছাড়া হাতে কলমে কাজ শেখার জন্য সাত আট জন অফিসারকে আমার সাথে সংযুক্ত করা হল। কয়েকদিন পর পর একজন অফিসার যায় আরেকজন আসেন। আর প্রায় ১০০ জনেরও অধিক কম্পিউটার অপারেটর যারা ছবি তোলা ও ডাটা এন্ট্রির কাজ করবেন।

রাওজান কলেজে আমাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হল। প্রতিদিন সকাল ছয়টার মধ্যে ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন এলাকায় চলে যাই। আর সন্ধায় ফিরে আসি। যদি কোন ডাটা এন্ট্রি করা পেন্ডিং থাকে তাহলে তা রাত জেগে ক্যাম্পে এসে শেষ করা হয়। দিনের কাজ দিনেই শেষ করতে হয়। সন্ধার পর উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনায় বসে সারা দিনের কাজ নিয়ে আলোচনা করি।

এই পরিচয় পত্র তৈরী করার প্রথম কাজটি হল ডাটা সংগ্রহ করা। এই ডাটা সংগ্রহের কাজটি করতেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক গন। কিভাবে ডাটা সংগ্রহ করতে হবে তা শিখিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা নির্বাচন অফিসারের নেতৃত্বে বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচন অফিসারের সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। তারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষন দিচ্ছেন।

আমি লক্ষ্য করলাম, শিক্ষকগন যা শিখছেন তা সরজমিনে প্রয়োগ করছেন না। বা পারছেন না। ফলে ডাটা অসম্পুর্ণ থাকে। আর এই অসম্পুর্ন ডাটা নিয়ে কাজ করা খুব বিপদজনক। এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য জেলা নির্বাচন অফিসারকে বললাম আমাকে যেন প্রশিক্ষনের সময় কিছু কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি সানন্দে আমার প্রস্তাব গ্রহন করলেন।

আমি প্রথমেই প্রশিক্ষনশালায় কথা বলার সুযোগ নিলাম। কয়েক শতাধিক শিক্ষক এসেছেন। কোন বেসামরিক পরিমন্ডলে কয়েক শতাধিক শিক্ষকের সামনে জীবনের প্রথম কথা বলছি। ভুমিকাতেই বললাম, আমার সামনে আপনারা যারা বসে আছেন তারা সবাই পেশায় শিক্ষক এবং সকলেরই বয়স ২৫ এর বেশী। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আপনারাই আমাকে শিক্ষার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। সেদিন আপনারা আমায় অ আ ক খ শিখিয়েছিলেন বলেই আজ আমি মেজর হয়ে আপনাদের সামনে আসতে পেরেছি। সেদিন আমাকে আপনারা না শিখালে আমি মেজর হতে পারতাম না। কুলি, মজুর, রিকসাওয়ালা বা কালা জাহাংগীর হতাম। মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ মেহেরবানীতে আমি তা না হয়ে আজ মেজর হয়েছি। সুতরাং আমার মেজর হওয়ার সকল অবদান বাবা মায়ের পর আপনাদের। আপনারা আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহন করুন।

আমার এহেন কথা শুনে আমি অনেক শিক্ষকের আনন্দাশ্রু কপাল বেয়ে পড়তে দেখেছি। এমন সম্মান তারা নাকি তাদের জীবনে কখনো পান নি। কিন্তু তাদের এই আনন্দঘন মুহুর্ত বেশী সময় স্থায়ী ছিল না। তার পর মুহুর্তেই আমার বাস্তবতার নিরিখে বলা কিছু কথায় তাদের মুখ পাংশু হয়ে যায়।

আমি বললাম, "স্যার, আমরা জাতীয় স্বার্থে কিছু কাজ করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছি। এই কাজটি নির্ভুলভাবে করতে হবে। কাজটা কতটুকু নির্ভুল হবে তার সিংহভাগ নির্ভর করছে আপনাদের উপর। আপনারা সঠিক ডাটা উপস্থাপন করলেই নির্ভুল পরিচয়পত্র তৈরী হবে। নচেৎ ভুল তথ্যে ভরা পরিচয়পত্র হবে। যা কারো কোন কাজে আসবে না। আমাদের সকল শ্রম বৃথা যাবে।

আপনাদের মনে আছে কি না জানি না। তবে আমার মনে আছে। আমি তখন ছোট ছিলাম। কোন বুদ্ধি ছিল না। অথচ পড়া পারিনাই বলে আমায় মেরেছিলেন। বেত দিয়ে পিটিয়েছিলেন। কান ধরে বেঞ্চের উপর দাড় করিয়ে রেখেছিলেন। ছোট অবুঝ বলে একটুও মায়া করেন নাই। সেই মাইরের দাগ এখনো আমার পিঠে হাতে আছে। সেই দিন গুলির কথা কখনো ভুলার নয়। তো আজ আপনারা যারা জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরীতে ডাটা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত আছেন তারা যদি কোন ভুল করেন তো আজ আমি কিন্তু কাউকে সম্মান করবো না। ছোট বেলার কথা মনে করবো।

আমার এহেন কথা শুনে হলে পিন পতন নিরবতা নেমে এলো। এ ওর মুখ পানে চায় আর ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো, এ কেমন কথা। ভুল হলে আমাদের মারবে না কি।" কয়েকজন অতি বিনীত ভাব নিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, " স্যার, ভুল তো হতেই পারে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। তাই বলে আমাদের শিক্ষকদেরকে.....।

তাদের এমন যুক্তি পুর্ণ কথা শুনে আমি বললাম, আপনারা যথার্থই বলেছেন। তবে কথা হলো, ভুল দুই ভাবে হতে পারে। এক জেনে শুনে ভুল। দুই অজানা ভুল। প্রথম ভুলটি ক্ষমার যোগ্য নয়। দ্বিতীয়টি ক্ষমার যোগ্য। আপনি যদি প্রথম ভুলটি করেন, তবে কি আমি কিছুই বলবো না? তা কি করে হয়? সবাই সমস্বরে বলল, স্যার, আমরা শিক্ষক। আপনাকে কথা দিচ্ছি প্রথম ভুলটি আমাদের দারা হবে না। " আমি তখন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আপনারা জেনে শুনে কোন ভুল করবেন না। এখন বাকি থাকে অজানা ভুল। সে ভুলের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। আর সে ভুল যেন না হয় তার ব্যবস্থা করার জন্যই আজকের এই কর্মশালা।

এরপর আমি পবিত্র আল কুরাআনের সুরা বাকারার একত্রিশ নম্বর আয়াত থেকে পয়ত্রিশ নম্বর আয়াতের অর্থ সহ পড়ে শুনালাম।

বললাম, মহান আল্লাহ তালা যখন মানুষ সৃস্টির কথা ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের জানালেন, তখন সকল ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম মানুষ সৃস্টি না করার জন্য মহান আল্লাহ তালাকে বলেছিলেন। মহান আল্লাহ তালা উনাদের কথা না রেখে আদম আলাইহিস সালামকে সৃস্টি করে সব কিছুই শিখিয়েদিলেন। অতপর ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামদের সামনে ঐ সমস্ত পণ্য রেখে তাদের নাম বলতে বললেন। ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামরা বললেন, আপনি আমাদের যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমরা আর কিছুই জানি না। তখন মহান আল্লাহ তালা আদম আলাইহিস সালামকে ঐসমস্ত পণ্যের নাম বলতে বললে তিনি সব নাম বলে দেন।" আমি উপস্থিত শিক্ষকদের প্রশ্ন করলাম, "কেন ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামরা পারেন নাই যা আদম আলাইহিস সালাম পারলেন?" শিক্ষক গন বললেন, " ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামদের শিখানো হয়নি। তাই উনারা পারেননি। অন্য দিকে আদম আলাইহিস সালামকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি পেরেছেন।" তখন আমি বললাম, "তাহলে এটা প্রমানিত যে আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তানদেরকে শিখিয়ে দিলে পারবেন?। আমরা যেহেতু উনারই সন্তান, সেহেতু আমাদের শিখিয়ে দিলে আমরাও পারবো। আমাদেরও ভুল হবে না। তাই তো?" তারা বললেন, "জী স্যার।" আমি এই কথাটাই তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম। তাদের এমন স্বীকারোক্তি পেয়ে একটা ফর্ম দেখিয়ে বললাম, "তাহলে আজ এই ফর্মটা কিভাবে নির্ভুল ভাবে ফিল আপ করতে হয় তা আপনাদের শিখিয়ে দেওয়া হবে। আশা করি আপনারা শিখে যাবেন এবং অজানা আর কিছুই থাকবেনা। ফলে ভুল হওয়ার কোন অবকাশ থাকবে না। আর আপনাদেরও কোন ভয় থাকবে না।"

এমনি ভাবে শিক্ষকদের থেকে নির্ভুল কাজ করিয়ে নিয়েছিলাম। তারপরও যে ভুল হয়নি তা বলা যাচ্ছে না। তবে তা ছিল খুবই নগন্য। একথা আমাকে সেনাসদরে কর্মরত একজন আমার পরিচিত অফিসার জানিয়েছিলেন। এমনি ভাবে জাতীয় পর্যায়ের কাজ করতে পেরে আমি এবং আমার দল নিজেদের গৌরবান্বিত ও ধন্য মনে করেছিলাম এবং একটি জিনিষ বুঝতে পেরেছিলাম দায়িত্ববোধ থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ফলাফল পাওয়া যায়।


শেয়ার করুন

0 facebook: