স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ একসময়ের তুখোড় বামপন্থী নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, মুহম্মদ ইউসুফ।। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া
থেকে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ
সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ধস নামিয়েছিলেন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর
`সাম্রাজ্যে'।
সংসদ
সদস্য শুনলে মানুষের চোখে যে ধরনের চেহারা ভেসে উঠে, মোহাম্মদ ইউসুফ তার
ব্যতিক্রম। অর্থ নেই,
বাড়ি-গাড়ি নেই। সংসারও নেই। নিজ গ্রামে ছোট ভাইয়ের
চা-দোকান থেকে আসা যৎসামান্য আয়ে ইউসুফের মুখে ভাত জোটে।
নব্বইয়ের
দশকেই মুহম্মদ ইউসুফ কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। রাজনীতিতে ক্রমাগত
পিছিয়ে যাওয়া শুরু হয় একসময়ের মাঠ কাঁপানো শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের এই নেতার। রাজনীতি থেকে বিদায়
নিতে হয়েছে। বার্ধক্যে পৌঁছা সেই মানুষটির শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর
দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
জীবনের
পড়ন্ত বেলায় যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাঁর
খোঁজও নেন না। দলত্যাগী নেতার পাশে নেই বামপন্থীরাও। কিন্তু দীর্ঘদিন পর
যন্ত্রণাক্লিষ্ট এই মানুষটির পাশে দাঁড়িয়েছেন একদল গণমাধ্যম কর্মী এবং ফেসবুক এক্টিভিস্টরা। ফেসবুকে-গণমাধ্যমে
সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফের অসহায় অবস্থা নিয়ে সরব হয়েছেন অনেকে।
ফেসবুকের
খবর পৌঁছে গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে টনক নড়েছে চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসনের। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত
জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাসুকুর রহমান সিকদার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে
সিভিল সার্জনকে সাবেক সংসদ সদস্যের চিকিৎসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন।
রোববার
(০৭ জানুয়ারি) সকালে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী দুটি অ্যাম্বুলেন্স
এবং তিনজন চিকিৎসক নিয়ে রাঙ্গুনিয়ায় মোহাম্মদ ইউসুফের বাড়িতে যান। অসুস্থ ইউসুফকে এনে
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জানতে
চাইলে সিভিল সার্জন সাংবাদিকদের বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফের সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন। সব ধরনের খরচ সরকার
বহন করবে। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখ আছে। আগে তিনি ব্রেইন স্ট্রোক
করেছিলেন।
আমরা বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করছি। হাসপাতালে উনার জন্য
কেবিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে উনাকে ঢাকায় নেওয়া হবে।
মুহম্মদ
ইউসুফের ছোট ভাই মুহম্মদ সেকান্দর সাংবাদিকদের বলেন, সকালে কয়েকজন ডাক্তার
আমাদের বাড়িতে গেছেন। আমার ভাইকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করেছেন।
তারপর হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।
মোহাম্মদ
ইউসুফের অসহায় অবস্থা নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি ফেসবুকে একটি মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস দেন চট্টগ্রাম
সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক ছাত্রনেতা হাসান ফেরদৌস। মূলত এরপরই বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে তোলপাড় উঠে।
আমেরিকা-ফ্রান্সসহ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসায় সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করে অনেকেই যোগাযোগ করেন
হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে। এরপর শনিবার (০৬ জানুয়ারি) হাসান ফেরদৌসসহ কয়েকজন সাংবাদিক নেতা
এবং একদল গণমাধ্যম কর্মী মোহাম্মদ ইউসুফের বাসায় যান।
বর্তমানে
চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস সাংবাদিকদের
বলেন, রাজনৈতিক কারনে সিপিবির অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে মোহাম্মদ ইউসুফ
আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগেই তিনি এমপি হয়েছিলেন। তবে এমপি হয়ে শুল্কমুক্ত কোটায় গাড়ি, গুলশান-বনানীতে প্লট, সরকারি সুযোগ কিংবা
ব্যবসা-বাণিজ্যের কমিশন নেননি। সৎ-নির্লোভ বলেই হয়ত
মৃত্যুপথযাত্রী এই রাজনীতিকের পাশে কেউ নেই। তবে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী
উনার চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
চট্টগ্রাম
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
ভাই আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। ইউসুফ ভাইয়ের সুচিকিৎসা হবে। আমরা দলীয়ভাবে উনার
পাশে আছি।
ওয়ার্কার্স
পার্টি চট্টগ্রাম জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান বলেন, ইউসুফ ভাই ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। উনার মতো একজন সৎ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিক, সাবেক সাংসদ এবং মুক্তিযোদ্ধার
এই পরিণতি কাম্য নয়। এটা আমাদের রাজনীতির লজ্জা, জাতির লজ্জা। উদীচী চট্টগ্রাম জেলা
সংসদের সহ-সভাপতি সুনীল ধর বলেন,
ইউসুফ ভাইয়ের মতো একজন রাজনীতিক, যে দলই করুক,
উনার এই অবস্থা বলে দেয় আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি
কতটা নিম্নগামী। লুটপাটের সংস্কৃতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমপি বললে এখন কিছু
দুর্বত্তের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে। এই নষ্ট রাজনীতিতে ইউসুফ ভাই আসলেই বেমানান।
একদিন
আগে শনিবার চট্টগ্রাম ঘুরে গেছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, যার সঙ্গে সিপিবি ছেড়েছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। শিক্ষামন্ত্রী রাউজান
গিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন,
নগরীতে এসে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম
মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় যান। কিন্তু রাজনৈতিক সহকর্মী মোহাম্মদ ইউসুফকে দেখতে যাননি। এতে ফেসবুকে ক্ষুব্ধ
প্রতিক্রিয়া জানান সংস্কৃতিকর্মী হাবিবুল হক বিপ্লবসহ অনেকে।
এদিকে
গণমাধ্যম কর্মী এবং সচেতন নাগরিকরাও মোহাম্মদ ইউসুফের চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। এজন্য রোববার রাত ৮টায় চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং
সোসাইটি কার্যালয়ে এক সভা আহ্বান করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন হাসান ফেরদৌস।
এছাড়া
বিভিন্ন সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ সাবেক এমপি মুহম্মদ ইউসুফের খোঁজ-খবর
নিয়েছেন, সাহায্য সহযোগিতাও করেছেন।
খবর বিভাগঃ
চট্টগ্রাম বিভাগ
জাতীয়
বিভাগীয় সংবাদ
0 facebook: