![]() |
কর্মচারীদের
জন্য আছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। আছে নিজস্ব ফুটবল ও ক্রিকেট দল। সকালে অনুশীলন করে
এসে কর্মচারীরা দোকান খোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য কর্মচারী ব্যবসা শিখে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান
গড়ে তুলেছেন। জায়গা-জমি কিনে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উত্তরাধিকারীদের
মধ্যে জ্যেষ্ঠ হচ্ছেন রাজশাহীর ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। তাঁর বয়স ৮৭ বছর।
তাঁর হাত দিয়ে অন্তত ৩০ জন কর্মচারী মালিক বনে গেছেন। বর্তমানে কর্মরত আরও প্রায় ৪০
জন কর্মচারী মালিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছেন।
এই প্রাচীন
ও ব্যতিক্রমী ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা
শুনেছি মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন। তিনি মানুষ হিসেবেও
ভালো। তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এক নম্বর গদি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এটির বয়স
কত তা জানি না। তবে আমি যত দিন থেকে রাজশাহীতে আছি, তত দিন থেকে দেখছি।’
মোশাররফ
হোসেন বললেন, কর্মচারীরা
এখানে ব্যবসাটা শেখেন। পরে নিজের পায়ে দাঁড়ান। কর্মচারীদের জন্য রয়েছে বার্ষিক আনন্দভ্রমণ।
সব কর্মচারীকে কোনো বছর রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, কোনো বছর দিনাজপুরের স্বপ্নপুরী, কোনো
বছর রংপুরের ভিন্ন জগৎ,
কোনো বছর বগুড়ার মহাস্থানগড় আবার কোনো বছর নাটোরের রাজবাড়িতে নিয়ে
যাওয়া হয়।
দোকানের
দোতলায় কর্মচারীদের জন্য রয়েছে থাকার ব্যবস্থা। সেখানে রয়েছে টেলিভিশন ও ফ্যান। কর্মচারীরা
সেখানে নিখরচায় থাকা-খাওয়ার সুয়োগ পান। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তাঁদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা
করা হয়। রান্নার জন্য দুজন বাবুর্চি রয়েছেন। প্রতিদিন সকালে ডাল-সবজি-ভাত, দুপুরে
মাছ-ডাল-ভাত, রাতে
ছোট মাছ-ভাত থাকে। সপ্তাহে দুই দিন দুপুরে মাংস থাকে।
প্রতিষ্ঠানের
কর্মচারীরা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ফুটবল ও ক্রিকেট দল। বাজার সমিতির সঙ্গে ফুটবল ও ক্রিকেট
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ট্রফিও জিতেছেন। পয়লা বৈশাখে পদ্মার চরে থাকে তাঁদের দিনব্যাপী
আয়োজন। চলে খেলাধুলা ও বিনোদনপর্ব। শুক্রবার ছুটির দিনে বেড়ানোর জন্য হাতখরচও পান তাঁরা।
প্রতিষ্ঠানটির
নাম শুরুতে ‘এক
নম্বর গদি’ ছিল, পরে মেসার্স
শব্দটি যোগ করা হয়েছে। মূলত এটি একটি মুদি দোকান। তবে তারা আরও পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির
পণ্যের পরিবেশক (ডিলার)। প্রতিষ্ঠানের প্রধান মোশাররফ হোসেন স্নাতক পাস করার পর শিক্ষা
বোর্ডে সেকশন অফিসার পদে চাকরিতে ঢোকেন। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘এক নম্বর
গদিতে’ বসেন।
তাঁর বাসায় বসে এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়। বললেন, তাঁর বাবার নানা ইয়াসিন মিঞা ও বাবার দাদা
জমির আখুঞ্জী মিলে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
সম্প্রতি
এক নম্বর গদিতে গিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা হয়। ছুটির দিন হলেও তাঁরা সকালে কিছু সময়ের
জন্য দোকান খোলা রাখেন। বর্তমানে দোকানের জ্যেষ্ঠ কর্মচারী আবু জাফর (৫৬)। তাঁর বাড়ি
কিশোরগঞ্জে। শুধু তিনিই নন,
দোকানের বেশির ভাগ কর্মচারীর বাড়িই কিশোরগঞ্জে। কারণ হিসেবে জানা
গেল, দোকানের
প্রতিষ্ঠাতার আদিনিবাস কিশোরগঞ্জে। আবু জাফর ৩১ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তিনিই ব্যবস্থাপক
কি না—জানতে
চাইলে বলেন, এখানে
আসলে কারও কোনো পদ নেই। দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব
দেওয়া হয়। এখানে কর্মচারীদের ১ হাজার থেকে শুরু করে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া
হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে ৪০ জন কর্মচারী কাজ করছেন। তাঁদের মুখেই শোনা গেল এই মুদি দোকান
শুধু একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কারখানা। আবু জাফর
বলেন, মালিকপক্ষের
একজন ছিলেন আবু সাইদ সেলিম। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা
শেষ করে চাকুরী খোঁজেননি। এক নম্বর গতিতে এসে বসেন। দুই বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
কথা বলতে
বলতেই একজন বয়স্ক লোক সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নেমে এলেন, তাঁকে
দেখিয়ে দোকানের কর্মচারীরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ওই দেখেন, উনিই আমাদের “খাদ্যমন্ত্রী”।’ পরে জানা
গেল তিনি আসলে প্রতিষ্ঠানের বাবুর্চি। ৩৬ বছর ধরে এখানে রয়েছেন, নাম কিতাব
আলী। প্রতিষ্ঠানের মুনাফার অংশ নিয়ে তিনি জমি কিনেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। বয়স হলেও
তিনি দোকান ছেড়ে যাননি।
কিসের
ভিত্তিতে মুনাফা দেওয়া হয়,
জানতে চাইলে আবু জাফর বলেন, ন্যূনতম যাঁদের বেতনের স্থিতি এক বছর হয়, তাঁদের
জমানো অংশ ব্যবসায়ের বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। তা থেকে বছর শেষে মুনাফার হিসাব করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠানে
চাকরি করে গত দুই বছর আগে রাজশাহী নগরের আরডিএ মার্কেটে একই ধরনের দোকান করেছেন কিশোরগঞ্জের
ব্যবসায়ী ফেরদৌস শিকদার। তাঁর দোকানে গিয়ে দেখা যায়, তিনিও জমজমাট ব্যবসা করছেন। এখান থেকে পুঁজি
নিয়ে গিয়ে কিশোরগঞ্জে দোকান করেছেন আনিসুজ্জামান (২৫)। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও
এক নম্বর গদিতে কাজ করার কথা স্বীকার করেন।
দোকানটি
কেমন
‘মের্সাস এক নম্বর গদি’র বিক্রয়
কেন্দ্রটি রাজশাহী নগরের প্রাণকেন্দ্রে আরডিএ মার্কেটের প্রবেশপথের ডান পাশে অবস্থিত।
বিক্রয় কেন্দ্রটির দুদিকে খোলা। এর দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট ও প্রস্থ ৩০ ফুট। এর পেছনে রয়েছে
গুদামঘর কাম অফিস। এই দোকানে যাবতীয় মুদি ও মনিহারি বিক্রি হয়। এদের নেসলে বাংলাদেশ, বসুন্ধরা
(টিস্যু, আটা, ময়দা, সুজি, কাগজ
ও খাতা) ও জেমস ফিনলে পিএলসির ডিলারশিপ রয়েছে। কর্মচারীরা পালাক্রমে কাজ করেন। ১২টি
ভ্যানগাড়িতে করে কর্মচারীরা পাইকারি ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেন।
এই প্রতিষ্ঠান
সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান বলেন, এটি রাজশাহীর
একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, তাঁর বয়স ৫২ হতে যাচ্ছে। তাঁর বুদ্ধি হওয়ার
পর থেকেই এই দোকানকে একইভাবে দেখে আসছেন। তাঁদের পণ্যের গুণগত মান ভালো, তাই বেচাকেনাও
ভালো।
সূত্রঃ
প্রথম আলো।
খবর বিভাগঃ
জাতীয়
ব্যবসা ও বাণিজ্য
0 facebook: