স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাকভি গত মঙ্গলবার হজ্জে ভর্তুকি প্রত্যাহার সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়েছেন। আর এই প্রত্যাহারের ঘোষণায় ভারতের মুসলিম নেতাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র
প্রতিক্রিয়া।
‘মুসলিমরা হজ্জ
বন্ধ করবে না’
এ প্রসঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গের গ্রন্থাগার ও জনশিক্ষা প্রসার দফতরের মন্ত্রী মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ
চৌধুরী রেডিও তেহরানকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘পবিত্র হজ্জ ইসলাম
ধর্মের বুনিয়াদী পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে মৌলিক একটি বিষয়। পবিত্র হজ্জ যাদের জন্য ফরজ, তারাই
যাবে। যারা অর্থসম্পন্ন মানুষ তারাই হজ্জে যাবে। ভিক্ষা করে, চেয়েচিন্তে
কেউ যাবে না। ভারত থেকে আমরা যারা হজ্জে যাই, ওখানে থাকা,
হোটেল
ভাড়া, খাওয়া সব নিজেদের খরচ করতে হয়। সরকার ব্যবস্থাপনা করে সাহায্য করে। ওখানে
ঘর নিয়ে রেখেছে, কিছু পরিসেবা দেয় এটা তাদের কাজ।’ তিনি
বলেন, ‘ভর্তুকি তুলে দিলে মুসলিমরা হজ্জ বন্ধ করবে না। ওসব চোখরাঙানিতে মুসলিমদের
কিছু আসে যায় না। যারা মহান আল্লাহ পাক ও রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বিশ্বাস রাখে তারা হজ্জ করবে। এসব করে ভারতের পরম্পরাকে নষ্ট করা হচ্ছে তাতে কোনো
সন্দেহ নেই। একদিকে জিএসটি, একদিকে অমুক, একদিকে তমুক,
ঘরে
ঘরে একেবারে উন্নয়নের জোয়ার! আর অন্যদিকে, হজ্জে ভর্তুকি
তুলে দেয়া- এসব বুঝে আসে না।
তাছাড়া অমরনাথ
তীর্থযাত্রা, কুম্ভ মেলায় সরকার কত ভর্তুকি দেয়? সারা
ভারতে তীর্থযাত্রীরা দৈনিক যেতেই থাকেন কোনো না কোনো জায়গায়। সরকার সেসব
ভেবেচিন্তে দেখুক।’ মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মুসলিমদের
বিব্রত করে কিছু লাভ হবে না। মনে হচ্ছে, মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয়
প্রবণতা, পাক ও রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বত বাড়ায় সরকার বিচলিত ও
উদ্বেগের মধ্যে আছে। হাজীদের সংখ্যা বেড়েছে, ওমরাহকারীদের
সংখ্যা বেড়েছে। যাতে হাজীদের সংখ্যা কমে সেজন্য সরকার ওই পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে
সরকার কোনো লাভবানই হবে না। সরকার যেভাবে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর পিছনে ৬
দিনের আতিথেয়তায় খরচ করছে, এরকম কত খরচই সে করছে। বিদেশযাত্রা করা হচ্ছে, অমুক,
তমুক
কত কিছু করা হচ্ছে। সরকার ওই সকল দিকে আগে লক্ষ্য দিক।’
মাওলানা
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিমানভাড়া আমরা দিচ্ছি, হোটেল ভাড়া,
কুরবানীর
পশু কেনার টাকা এমনকি নিজের কাফনের কাপড়ও হাজীরা নিজেরা কিনে নিয়ে যায় যাতে কারো
দ্বারস্থ হতে না হয়। এত ত্যাগ স্বীকার করে যারা হজ্জ করতে পারে তাদেরকে সরকার
দেখুক না পরীক্ষা করে। সারা বছর ধরে লাখ লাখ মানুষ ওমরাহ হজ্জ করতে যায়। সরকারি
পদক্ষেপে কি যায় আসে? বিজেপিকে দেখে কি কেউ হজ্জ করতে যায়? বরং মহান আল্লাহর
রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা হজ্জ করে।’
‘ভর্তুকি এক ধরণের
প্রতারণা’
এ প্রসঙ্গে
জামায়াতে ইসলামী হিন্দের পশ্চিমবঙ্গের আমীর মুহম্মদ নূরুদ্দিন বলেন, ‘কেন্দ্রীয়
মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাকভি ঘোষণা দিয়েছেন ভারত সরকার হজ্জযাত্রীদের যে ভর্তুকি
দিয়ে থাকে তা তুলে দেয়া হবে। সেই অর্থ মুসলিম নারী ও শিশুদের উন্নয়নের কাজে লাগানো
হবে। সরকার প্রায় ১৭০ কোটি টাকা হজ্জ ভর্তুকিতে ব্যয় করে। সরকারি ওই সিদ্ধান্তের
নানারকম দিক আছে। জামায়াতে ইসলামী হিন্দ সরকারি ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে
কিন্তু সেইসাথে কতগুলো প্রশ্নও আমরা রাখতে পারি। সরকার বলেছে যে, তারা
তোষণ চায় না। তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের এমপাওয়ারমেন্ট চায়, নারী
ও শিশুদের উন্নয়ন চায়। আমরাও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের
তোষণের প্রয়োজন নেই, তাদের যথার্থ অধিকার দেয়া দরকার।
হজ্জে ভর্তুকি
প্রসঙ্গে যা বলা হয় তা আসলে ভর্তুকি নয় আর শুধু মুসলিমদেরই তা দেয়া হয় না। ভারতের
বিভিন্ন সম্প্রদায় এখানে হিন্দু, খ্রিস্টান ইত্যাদি সকলেই তীর্থযাত্রা
করে থাকেন। অক্ষরধাম যাত্রা, গঙ্গাসাগর যাত্রাসহ বিভিন্ন তীর্থযাত্রায় সরকারকে
ব্যবস্থাপনা করা থেকে শুরু করে তাদের থাকা ও চিকিৎসার জন্য ব্যাপক অর্থ সেখানে
ব্যয় করতে হয়। সুতরাং সরকার কেবল মুসলিমদের নয় বরং ভারতের যেকোনো সম্প্রদায়ের
তীর্থযাত্রীদের জন্য সরকারকে খরচ করতে হয়। মুসলিমদের হজ্জযাত্রার ক্ষেত্রে যা করা
হয় তা হল সরকারের নির্ধারিত বিমানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই বিমানের ভাড়া বাজার দরের
চেয়ে অত্যন্ত বেশি। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে হজ্জযাত্রীদের বেশি ভাড়া দিতে বাধ্য করা এবং
সেই বাধ্য করা ভাড়া থেকে কিছুটা কমিয়ে সেটাকে ভর্তুকি বলে প্রচার করা হচ্ছে। এটা
এক ধরণের প্রতারণা!’
তিনি বলেন,
‘আমাদের
দাবি হচ্ছে এটা যে হজ্জ যাত্রার ক্ষেত্রে ওপেন টেন্ডার ডেকে স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে
ভারতের হজ্জযাত্রীরা হজ্জে যেতে পারেন সেখান থেকে হজ্জ সম্পন্ন করে সুষ্ঠুভাবে
ফিরে আসতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা হোক। এবং এটা এমনভাবে করা হোক যাতে প্রত্যেকে
তাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্য অনুসারে তারা হজ্জ করতে পারেন। যার অর্থ বেশি আছে সে
দামী ফ্লাইটে যেতে পারে, ভালো হোটেলে থাকতে পারে সেটা তার ব্যাপার। যার পয়সা
কম আছে সে কম দামের ফ্লাইটে যাবে সে নিজের মতো যাবে এরকম সুযোগ থাকা উচিত।
সরকার পানি
জাহাজের মধ্য দিয়ে গরীব হজ্জযাত্রীদের ব্যবস্থাপনা করবে বলে বলছে সেটা করতে পারে
কিন্তু পানি জাহাজে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। হজ্জ সব মুসলিমদের জন্য ফরজ নয়। হজ্জে
যাওয়া এবং সেখান থেকে ফিরে আসার মত আর্থিক এবং পথের নিরাপত্তা আছে এই সঙ্গতি যাদের আছে তাদেরকেই শুধু হজ্জ করার
নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
মুহম্মদ
নূরুদ্দিন বলেন, ‘আমরা সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই কিন্তু
মুসলিমদের সুযোগ সুবিধা, নারী ও শিশুদের কল্যাণের যে কথা বলা হচ্ছে সেদিকে
সরকার নজর দিক। মুসলিমদের যথার্থ অধিকার প্রদান করা হোক। তোষণ নয়, মুসলিমরা
চায় ভারতে তাদের পূর্ণ অধিকার এবং সেই অধিকার তাদেরকে দেয়া হোক। এ বিষয়ে যেন সরকার
সতর্ক হয়।’
‘কেবল মুসলিমদের
ভর্তুকি প্রত্যাহার কেন?’
জমিয়তে উলামায়ে
হিন্দের পশ্চিমবঙ্গের সম্পাদক মুফতি আব্দুস সালাম বলেন, ‘মুসলিমদের জন্য
হজ্জ তখনই ফরজ হয় যখন সে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়। এখানে কারো ভিক্ষার প্রয়োজন
আছে বলে আমরা মনে করি না। কিন্তু সরকার যে ভর্তুকি দেয় তাও আমরা জানি না। হজ্জে
কিছু পরিকাঠামোগত খরচ ভারত সরকার করে, সেখানে কিছু পরিসেবা দেয়, কিছু
ডাক্তার পাঠায়, ব্যবস্থাপনার জন্য লোক পাঠায়, সেজন্য
অফিস ভাড়া করে। কিন্তু ওই ব্যবস্থাপনা যদি কেন্দ্রীয় সরকার না করতে চায় তাহলে
আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে কেবল মুসলিমদের ভর্তুকি প্রত্যাহার কেন?
অন্য
ধর্মের যে তীর্থযাত্রা রয়েছে কাশ্মিরে অমরনাথ তীর্থযাত্রা থেকে অন্যান্য জায়গায়
যেমন গঙ্গাসাগর মেলা, কুম্ভমেলা হয় এসব ক্ষেত্রে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ
করে, পরিসেবা দেয় সেসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কোনো পদক্ষেপ করতে চায় না কেন?
সেখানে
কাটছাঁট করতে চায় না কেন? কেবলমাত্র মুসলিমদের উত্তেজিত করা, বিভ্রান্ত
করা এবং ধর্মীয় আবেগ তৈরি করাই কী বিজেপিশাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ? এসব
হল সস্তা রাজনীতি। এ ধরণের রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত।’
‘মুসলিমরা কি কাঙাল
নন?’
এ প্রসঙ্গে সারা
বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজামান বলেন, হজ্জ
ভর্তুকির নামে মুসলিমদের সম্মানকে কেন্দ্রীয় সরকার ছোট করে দেখিয়েছে। মুসলিমরা
কোনোভাবেই কোনো সময়েই সরকারি পয়সায় হজ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত করবেন তারা
চাননি। কিন্তু সরকার পরোক্ষভাবে হাজী সাহেবদের কাছ থেকে বেশি অর্থ নিয়ে দীর্ঘদিন
ধরে এয়ার ইন্ডিয়াকে সুবিধা দেয়ার কাজ চালিয়ে এসেছে এবং হজ্জে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে
প্রচার করে সরকার মুসলিমদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছে।’
তিনি বলেন,
‘সরকারের
কাছে আমাদের দাবি, যে বিমান সংস্থাকে দিয়ে হজ্জযাত্রীরা কম খরচে যাওয়া
আসা করতে পারবেন সেই সংস্থাকে দিয়েই যেন তাদের যাওয়া ও আসার ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে
তিনি টেন্ডারের মাধ্যমে প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে যাতে কম খরচে হজ্জে যাওয়া যায় তার ওপরে জোর দিয়েছেন।
মুহম্মদ
কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভর্তুকি তুলে দেওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরে ১ লাখ ৭৫ হাজার
মানুষ পবিত্র হজ্জে যাবেন। সুতরাং মুসলিমরা কাঙাল নন, তারা ভর্তুকি
পাওয়ার প্রত্যাশা রাখেন না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই সরকারের কাছে প্রত্যাশা মাত্র।’
এ
প্রসঙ্গে তিনি বিগত দিনে এয়ার ইন্ডিয়ার মাধ্যমে হজ্জে গিয়ে হাজীরা যেভাবে চূড়ান্ত
ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন তা তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
খবর বিভাগঃ
ধর্ম ও জীবন
0 facebook: