22 January 2018

যুক্তরাষ্ট্রের পতন কী তবে অত্যাসন্ন

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে নিশ্চিত করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে, সেই দেশে শুধু শান্তিই বিরাজ করেনি, অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও এসেছেকিন্তু আজকের যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে এই শক্তিদ্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে এবং ফলে স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে তার আগের ভূমিকায় থাকতে পারছে নাএটা শুধু ইরাকেই নয় যদিও সেখানেই এই মার্কিন অক্ষমতা সম্ভবত সবচেয়ে সুস্পষ্টইরাকে শুধু স্থিতিশীলতাই আয়ত্তের বাইরে নয়, সেখানকার সমগ্র পরিস্থিতি একটি পরাশক্তির মনোবল ভেঙে দিতে যথেষ্টতবু শুধু ইরাকই মার্কিন শক্তির অধোগতির সূচক নয়

এই শক্তির অবক্ষয়ের পেছনে আরো বেশ কিছু উপাদান সক্রিয়এগুলো হচ্ছে প্রথমত, চীনের অর্থনীতির বিস্ময়কর উত্থানতারপর আরো রয়েছে পারমাণবিক শক্তির ক্রমবিস্তৃতি, মুক্ত বাণিজ্যে অনেক দেশের অনীহা, সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বেড়ে যাওয়া, যার ফলে অনিবার্যভাবে সামরিক খাতে করতে হয় ব্যয় সঙ্কোচনএ ছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত মিত্র, যেমন ইউরোপ ও জাপানের শক্তি কমে যাওয়া

তবু বাস্তবতার মাপকাঠিতে প্যাক্স অ্যামেরিকানার উত্তরাধিকার নগণ্য নয়হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের পর পৃথিবীতে এর আর কোনো পাশবিক পুনরাবৃত্তি হয়নিদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি মানুষ নিহত হয়েছিলএ ব্যাপক হারে পৃথিবীতে আর কোনো জীবনহানি হয়নিযদিও সঙ্ঘাত কখনো থেমে থাকেনিতার পরও অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ, চীনের গৃহযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার সংঘর্ষমেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী কঙ্গোতে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, ভিয়েতনামে ২০ লাখের কাছাকাছি এবং কোরিয়া ও চীনে আরো কমপৃথিবীতে সঙ্ঘাত বিরাজ করলেও তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকেএর পেছনে পরোক্ষভাবে হলেও মার্কিন শক্তির অবদান অনস্বীকার্য

মার্কিন সামরিক শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ইউরোপ এবং অন্যত্র বিশেষ করে জাপানে গণতন্ত্রের অভ্যুদয় হয়েছিল১৯৭৭ সালে পৃথিবীতে ৮৯টি স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত দেশ ছিল এবং গণতান্ত্রিক দেশ ছিল মাত্র ৩৫টি২০০৫ সাল অবধি সেই চিত্র পাল্টে যায়সে সময়ে পৃথিবীতে মাত্র ২৯টি স্বৈরশাসিত দেশ অবশিষ্ট ছিল এবং গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৮৮ তে

যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় বিশ্ব যে সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছিল তা ছিল অভূতপূর্বইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন বলেন, ১৯৫০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ছয় গুণবিশ্ববাণিজ্য ২০ গুণ বেড়েছিলপ্রবৃদ্ধির এই হার এর আগে মানবজাতির অভিজ্ঞতায় ছিল নাজীবনযাত্রার মান ঊর্ধ্বিত হয়েছিল অকল্পনীয়ভাবে১৯৫০ সাল থেকে মানুষের আয় বেড়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬ গুণ, জাপানে ১১ গুণ এবং স্পেনে ৬ গুণঅপেক্ষাকৃত উচ্চ মান থেকেও জার্মানিতে এই আয় বেড়েছে পাঁচ গুণ, ফ্রান্সে চার গুণ ও যুক্তরাষ্ট্রের তিন গুণশেষোল্লিখিত সমৃদ্ধ দেশগুলোতে আয়ের পরিমাণ আগেই ঈর্ষণীয় ছিলতাই তাদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম হারে প্রবৃদ্ধিও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ

তবে বিশ্ব ইতিহাসের এই বিস্ময়কর সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটেছিল বলে মনে করা হবে নির্বুদ্ধিতাসেই মার্শাল প্লানের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনগুলোর ওপর একটি স্থিতিশীল প্রভাব রেখেছিলযদিও ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো কিছু কিছু অশুভ ক্রিয়াকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই দায়ী ছিলতবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় সত্তর দশকের মুদ্রাস্ফীতি এবং বর্তমান ইরাকের কারণে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা ইতিহাসের বিপথগামিতারই অংশমার্কিন শক্তির সাফল্যের দিকগুলোতে বিশ্বের নিরাপত্তায় একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিলযুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বময় বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং ব্যবস্থাপনা বিশ্বকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল

যুক্তরাষ্ট্র এর দারুণ দুর্দিনেও মুক্ত রেখেছে তার বাজারঅন্য কোনো শক্তি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি সহ্য করত নাকিন্তু এই পরাশক্তি প্রায় বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি সত্ত্বেও তার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নিআমদানি বাণিজ্য সঙ্কোচনেরও কোনো চেষ্টা করেনি মার্কিনিদের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শিক্ষাই ছিল যে এমন একটি বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে যুক্তরাষ্ট্রকেই বিশ্বের স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে হবেতাই এ দেশটি স্বল্পমেয়াদি বেশ কিছু দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ও ঝুঁকির সম্ভাবনাকে এড়াতেকিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ জয়ের পর এক ধরনের অপরাজেয় মনোভাব দেশটিকে মাত্রাতিরিক্ত আস্থা দিয়েছিলমার্কিনিরা ভেবেছিল, তাদের প্যাক্স অ্যামেরিকানা চিরস্থায়ীভেবেছিল যে, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছেভেবেছিল যে, গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্জনের পথে আর কোনো বাধা নেইভেবেছিল, যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি থেকে মহাপরাশক্তিতে বা হাইপারপাওয়ারে পরিণত হয়েছেএমন প্রবণতাই প্যাক্স অ্যামেরিকানার কাল হয়েছেসভ্যতার উত্থান-পতনের কথা বিস্তৃত হয়েছেকিন্তু অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও পতনের চূড়ান্ত সময় উপনীত না হলেও তার উপসর্গগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। 


শেয়ার করুন

0 facebook: