আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ মনিকার সাথে উইলিয়ামের দেখা পেরুর এরেকুইপাতে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসে মনিকা এখানে প্রাইমারি স্কুলে ইংরেজি পড়াচ্ছে। স্থানীয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দুজনে মিলে দ্বৈতসঙ্গীত গেয়েছিল। মনিকার গানের গলা বেশ উঁচু। ছেলেদের হিসেবে উইলিয়ামেরটাও একই রকম। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নিতে উইলিয়ামের আগমন এই ক্যাম্পাসে। দুজনের রোমান্সের শুরুটাও হয়েছিল দুর্দান্ত একটা স্প্যানিশ ফোক গান দিয়ে। গানের প্রথম লাইন ‘আমি তোমায় ভালোবাসি। এভাবেই শুরু, হঠাৎ একদিন ’‘চলো, অন্যরকম কিছু করি। জঙ্গলে হানিমুন করি।’ ফিঁয়াসে উইলিয়াম জি’কে প্রস্তাব দিল মনিকা গ্লেন।
বিয়ের অনুষ্ঠানটাও ছিল সব দিক থেকে চমৎকার। ২০০৫ সালের ২১ আগস্ট পেরুর প্রাচীন এক চার্চের লন বেয়ে হেঁটে এল মনিকা। পরনে হাতে বোনা পোশাক, হাতে ধরা একগুচ্ছ ফুল, পেছনে আনন্দে উচ্ছল আত্মীয়স্বজন। শুধু বিয়েতে অংশ নিতেই সুদূর আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছে তারা। বিয়ের দুই দিনের মাথায় উচ্ছ্বসিত নবদম্পতি চলেছে রাজধানী লিমার পথে। ১৪ ঘণ্টার সফরের শুরুটা ছিল উপকূলীয় আঁকাবাঁকা পথে। ২৭ বছর বয়স, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা বাদামি চুলের ঢেউ, মনিকা সব সময়ই দারুণ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে পিচ কর্পসে যোগ দিয়েছিল মনিকা। ইংরেজি পড়াতে গিয়েছিল চীনের এক গ্রাম্য এলাকায়। নতুন সংস্কৃতি চষে বেড়ানোর সাধ এখনো তার রক্তে। সেই সূত্রেই এরেকুইপাতে শিক্ষকতার চাকরি, সাথে পেল উইলিয়ামকে।
ঝাঁকুনি খেতে খেতে বাস এগোচ্ছিল। মনিকা তখন গাইডবুকে ডুবে। পড়ছে পেরুর রেইনফরেস্টের গল্প। পৃথিবীর প্রাণিবৈচিত্র্যের অন্যতম প্রধান জায়গা এই রেইনফরেস্ট। ‘কিছু বানর দেখলে কেমন হয়?’ উইলিয়ামকে লোভ দেখাল মনিকা।
পরিকল্পনাটা মোটামুটি এ রকম: প্লেনে প্রথম যাওয়া হবে উত্তর-পূর্বের পুকাল্পা শহরে। ওখান থেকে ইকুইটস। আমাজন নদীমুখের সবচেয়ে কাছাকাছি শহরগুলোর একটা এই ইকুইটস। বহু ঝুলন্ত ব্রিজ, অনেক উপরে জঙ্গলে গাছের ওপর দিয়ে বানানো ঝুলন্ত চলাফেরার রাস্তা আর দারুণ রোমাঞ্চকর রিভারক্রুজের জন্য বিখ্যাত এ জায়গা।
বোটে করে আমাজন নদীতে চার দিনের একটা ভ্রমণের পরিকল্পনাও তাদের ছিল। গহিন জঙ্গলের মধ্যে মশারি ঘেরা এক বিছানায় হানিমুনের স্বপ্ন সবাই দেখে না, কিন্তু ওরা দেখেছিল। পুরো ব্যাপারটা ছিল সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার।
লিমা বিমানবন্দরে দেখা গেল আরেক আমেরিকান গ্যাব্রিয়েল ভিভাসকে। গোলগাল মুখশ্রী, নাবিক-ছাঁটের চুল আর মুখভর্তি হাসি তার। গ্যাব্রিয়েলও বেরিয়েছ ভ্রমণে। বিরাট লাল-সাদা ট্যান্স পেরু এয়ারলাইনারে আরোহণের অপেক্ষায় আছে সে। হ্যান্ড লাগেজ আর শপিং ব্যাগভর্তি উপহারের ঝুলি নিয়ে সাথে আছে তার স্ত্রী ডায়ানা। নিউইয়র্ক থেকে এ ভ্রমণের জন্য রীতিমতো অর্থ জমাতে হয়েছে এই দম্পতিকে। পাঁচ ছেলেমেয়েকে ছেড়ে এটাই তাদের প্রথম ভ্রমণ। পুকাল্পা ভ্রমণের ইচ্ছা তাদের। ওখানে গ্যাব্রিয়েলের বাবার সাথে সাক্ষাৎ হবে ডায়ানার।
প্লেনের ব্যাপারে ভয় আছে ডায়ানার। অডিও যন্ত্রপাতির দোকানে ম্যানেজারের কাজ করে গ্যাব্রিয়েল। ডায়ানাকে বোঝাল, ভয়ের কিছু নেই। ‘জাস্ট একটু লাফ-ঝাঁপ ঝাঁকুনির মতো ব্যাপারটা।’ ট্রিপটা তাদের জন্য স্পেশাল ছিল আরেকটা কারণে। তাদের সাথে আছে গ্যাব্রিয়েলের ভাই জোসি আর তার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে জোসেলিন মেতে আছে তার ১৫তম জন্মদিন নিয়ে। ল্যাটিন আমেরিকায় দিনটিকে বলে কুইনসেনটিরা। শৈশব কাটিয়ে আজ প্রাপ্তবয়স্কদের দলে যোগ দিয়েছে জোসেলিন। শিগগিরই একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানও হবে। নাচ, গান, পাঁচতলা কেক আর গোলাপ দিয়ে উদযাপন হবে অনুষ্ঠানটি।
ব্যাকপ্যাক পিঠে, সিডি আর স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য কেনা ৪৫টি উপহারের ব্যাগ সাথে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছে ভিভাস পরিবারের এই ক্ষুদ্রাংশ। বোয়িং ৭৩৭-এ ওঠার সময় হয়েছে।
সিটের সারির মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল আরোহীরা। সিট খুঁজে নিয়ে, লাগেজ গুছিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে নিচ্ছিল সবাই। ৯২ আরোহী আর ছয় ক্রুসহ ২০৪ নম্বর ফ্লাইটটি ছিল প্রায় ধারণক্ষমতার কাছাকাছি ভর্তি। বেলা ২টা ২৪ মিনিটে রানওয়ে ছেড়ে ঝকঝকে আকাশে উড়াল দিল বিমান। লিমার ঘরবাড়ির ওপর দিয়ে তীর্যকভাবে ১০ হাজার ফুট ওপরে উঠে এরপর মাটির সমান্তরালে চলতে শুরু করল। ৪৮০ কিলোমিটার পথ পেরোতে হিসাব মতো নেয়ার কথা এক ঘণ্টা।
কেবিন ক্রু পাওলা হেঁটে হেঁটে যাত্রীদের এটা-ওটা সার্ভ করছিল। যাত্রীরা ঝুঁকে আছে জানালার কাছাকাছি যাতে নিচের পৃথিবীটাকে আরেকটু ভালো করে দেখা যায়।
পাওলার দায়িত্ব ছিল বিমানের পেছনের দিকটা। ট্যান্স বিমানে সব সময় সিনিয়রিটি অনুসারে কাজ বণ্টন করা হয়। পাওলা ভেবেছিল তার হয়তো সামনের দিকে দায়িত্ব পড়বে। কেন কে জানে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পেছনের দ্বিতীয় একটা টিমে। এগুলো দেখাশোনা করা অবশ্য তার জন্য সহজ। মাত্র তিন বছরে দুটো এয়ারলাইন্সে কাজ করেছে পাওলা। কিন্তু এরই মধ্যে আবহাওয়ার পাগলামি, গেঁয়ো যাত্রী কিংবা এয়ার-সিক ছেলেমেয়ে সবই সামলানো শিখেছে সে।
‘নিচে দেখো, কত্তো সুন্দর!’ শোনা গেল ডায়ানা ভিভাসের গলা। বিমান তখন আন্দিজ পর্বতমালার উপরে। ঘন সবুজে ছাওয়া অদ্ভুত সুন্দর সারিবাঁধা পর্বতমালা আন্দিজ। এখানে-ওখানে চকচকে নীল নদী আর লেক দিয়ে সাজানো। ডায়ানার পাশে গ্যাব্রিয়েলও চুপ নেই। পিচ্চি একটা ইন্ডিয়ান গ্রাম চোখে পড়েছে তার। ‘ওই সব গ্রামের লোকজন এখনো নদীতে যায় তাদের কাপড়-চোপড় কাচতে’, স্ত্রীকে বলল সে। ওদিকে তাদের পেছনের সারিতে বসে কেক আর ড্রিংকস শেষ করে চলেছে দলের তিন কনিষ্ঠ সদস্য।
মনিকা গ্লেন ঘুমিয়ে গেছে। উইলিয়াম অবশ্য জেগে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র উইলিয়াম স্বেচ্ছাসেবী ফায়ারকর্মীও বটে। ১৯৯৬তে তাদের বাড়ির কাছে যে প্লেন ক্র্যাশ করেছিল, তারই বিভিন্ন দৃশ্য কল্পনায় ভাসছিল তার। দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিল সে তখন। কিন্তু ১১৭ জন যাত্রীর কাউকেই জীবিত পাওয়া যায়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই জরুরি নিরাপত্তা কার্ডটা বের করে পড়তে শুরু করল উইলিয়াম। জরুরি মুহূর্তে যাত্রীদের সবচেয়ে কাছের দরজা দিয়ে বেরোতে বলেছে। আশপাশে তাকিয়ে উইলিয়াম দেখল সবচেয়ে কাছের দরজা তাদের দুই সারি সামনে।
ট্যান্স পেরু এয়ারলাইন্সের এই বোয়িং ৭৩৭-এর মতো বিমান আছে মোট তিনটা। বিমানে মোট ২০টা সারি, ইমার্জেন্সি এক্সিট চারটা। একটা সামনে, একটা মাঝামাঝি আর দুটো পেছনের দিকে। সরকারি এ বিমানগুলো দিয়েই জঙ্গল আর পাহাড়ি শহরগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখে লিমাবাসী। দরিদ্র দেশগুলোর দুর্গম এলাকাগুলোতে আকাশপথে যাতায়াতে ঝুঁকিও আছে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৫ সালের নিরাপত্তা রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমে তৈরি এয়ারক্র্যাফটগুলো উত্তর আমেরিকার চেয়ে ল্যাটিন আমেরিকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে ১৩ গুণ বেশি। এ এলাকার ৭০ শতাংশ বিমান দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকূল আবহাওয়া, যে দুর্ঘটনাগুলোয় বিমান মোটামুটি পাইলটের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এ জাতীয় দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিমান ক্রুদের দক্ষতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অন্যদিকে ২০০৩-এর জানুয়ারিতে পর্বতে আছড়ে পড়েছিল ট্যান্স এয়ারলাইন্সের একটা বিমান। বিমানের ৪৬ যাত্রীর সবাই মারা গিয়েছিল ওই দুর্ঘটনায়।
ঘুম ভেঙেছে মনিকার। ‘নিচে তো দারুণ সবুজ!’ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সে বলল। বড় বড় চোখ নিয়ে যখন সে নিচে দেখছিল, তখন পাইলটের গলা শোনা গেল। সিটবেল্ট বাঁধার নির্দেশ। মিনিট দশেকের মধ্যে পুকাল্পা বিমানবন্দরে ল্যান্ড করবে বিমান।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। ৭৩৭ নামতে শুরু করেছে। বাইরে আকাশ রীতিমতো অন্ধকার। জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে। ঝাঁকুনি খেতে শুরু করেছে বিমান।
পাওলা চু পানীয় সার্ভ করে ট্রলিটা জায়গামতো রাখতেই জ্বলে উঠলে সিট বেল্ট বাঁধার বাতিটা। কেবিন বস সার্ভিস ফোনে ক্রুদের সিটে বসতে বলছেন। ততক্ষণে পাওলা টের পেয়েছে আবহাওয়ার অবস্থা সুবিধার নয়। সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ সাধারণত যাত্রীদের জন্য। সে আর তার সঙ্গী পেছনের দরজার পাশে সিটে বসে পড়ল। কিছুটা আনমনেই বলা যায় পাওলা তার মেকআপ ঠিক করে নিচ্ছিল। দক্ষতার সাথে লিপস্টিকটা বুলিয়ে নিচ্ছিল ঠোঁটে। ততক্ষণে বিমান দুলতে শুরু করেছে।
আবহাওয়ার অবস্থা তখন আরো খারাপের দিকে। বিমান রীতিমতো কাঁপছিল। তারপরই একটা তীক্ষ ঝাঁকুনি দিয়ে অনেকটা নিচে নেমে গেল বিমান। ‘ওহ, মাই গড!’ চিৎকার করে উঠল ডায়ানা ভিভাস। স্বামীর বাহু আঁকড়ে ধরেছে সে। ‘ভয় পেয়ো না, এ রকম মাঝে মধ্যে হয়।’ স্ত্রীকে আশ্বাস দিলেও ভেতরে ভেতরে নিজেই কাঁপতে শুরু করেছে গ্যাব্রিয়েল। জানালা গলে গাছপালার মাথা চোখে পড়ল তার। ‘ স্রষ্টা বাঁচিয়ছেন, প্রায় নেমে এসেছি আমরা।’ নিজেকে বোঝাল সে। পেছনের সারিতে তার ভাতিজীরা রীতিমতো চিৎকার করছিল। বিমান তখন এগোচ্ছে ঝাঁকুনি দিয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে।
ভয়ে সাদা হয়ে গেছে মনিকার চেহারা। সিটের হাতল খাঁমচে উইলিয়ামের দিকে তাকাল সে, ‘অবস্থা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই।’
এতক্ষণে আতঙ্ক গ্রাস করেছে পাওলাকেও। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ৫০ ফুট নিচে নেমে থেমে গেল বিমান। তারপর আরো ৫০ ফুট নামল। বাইরে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না পাওলা কিন্তু ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দটা কানে এল তার। ল্যান্ডিংয়ের আগে ওরকম শব্দ করে ইঞ্জিন। ততক্ষণে জানালায় বৃষ্টির সাথে শিল পড়তে শুরু করেছে।
বিমান এখন নিয়ন্ত্রণহীন। দুলছে, ঝাঁকুনি খাচ্ছে, ভয়ঙ্করভাবে নিচে নামছে। কেবিনের বাতিগুলো নিভে গেছে। বাঁশের বেড়ার ওপর দিয়ে লাঠি নিলে যেমন শব্দ হয়, তেমন ট্যাট-ট্যাট শব্দ শুনতে পেল পাওলা। জানালায় গাছের ডাল বাড়ি খাওয়ার শব্দ। ঘন রেইন ফরেস্ট ছিঁড়তে ছিঁড়তে নামছিল বিমান! তারপরই প্রচণ্ড জোরে মাটিতে আছড়ে পড়ে দুই টুকরো হয়ে গেল ওটা।
গ্যাব্রিয়েলের সামনের সিটগুলো বাতাসে উড়ে গিয়েছিল। মাথার উপরে অক্সিজেন মাস্ক ঝুলছিল। ডায়ানার তখন অন্য চিন্তাঃ ‘ছেলেমেয়েদের আর কখনো দেখতে পাব না।’ নিজের সিটের সামনেই ছিটকে পড়েছিল গ্যাব্রিয়েল। হঠাৎই মুখের ওপর প্রচণ্ড উত্তাপ টের পেল সে। কেউ যেন তার মুখের ওপর আগুনের হলকা বইয়ে দিল। সামনে তাকিয়ে কমলা রঙের একটা আগুনের গোলা ফাটতে দেখল সে।
‘সিট বেল্ট খুলতে পারছি না’, ডায়ানার আতঙ্কিত চিৎকার শোনা গেল। বিমানে তখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। মাঝখানের প্যাসেজ অন্ধকার আর গাঢ় ধোঁয়ায় ভর্তি। সিট থেকে ছিটকে ছিটকে বেরোচ্ছিল যাত্রীরা। সবারই টার্গেট প্যাসেজ। চিৎকারে বিশৃঙ্খলা হয়েছে দ্বিগুণ। গ্যাব্রিয়েল ডায়ানাকে আঁকড়ে ধরে তার সিট-বেল্ট খুলে দিল। আরেক হাতে ভাতিজী জারলাইনকে ধরে দুজনকেই ঠেলে দিল সামনের প্যাসেজে। ‘আগাও, দ্রুত!’ চিৎকার শোনা গেল তার। নিজে এগোতে গিয়ে পেছনে আরেকটা আর্তচিৎকার শুনতে পেল গ্যাব্রিয়েল ‘আয়ুডা, আয়ুডা!’ সিট-বেল্টে আটকা পড়ে স্প্যানিশ ভাষায় চিৎকার করছে পেরুভিয়ান এক মহিলা। সিট-বেল্ট খুলে তাকেও সামনের প্যাসেজে ঠেলে দিল গ্যাব্রিয়েল।
ধোঁয়া এত ঘন ছিল যে কেউই কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। সামনের কিছু যাত্রী প্যাসেজে ঢুকতে না পেরে বিমানের মাঝখানের পানি নির্গমনের পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেছে।
উইলিয়াম আর মনিকা ততক্ষণে সিট থেকে মুক্ত হয়েছে। মনিকা এগোচ্ছিল দুই সারি সামনের দরজার দিকে। কিন্তু উইলিয়ামের চিৎকার শোনা গেল, ‘না, পেছনের দরজা দিয়ে।’ নির্দেশনার সাথে না মিললেও উইলিয়াম জানত সে-ই সঠিক। বিমানের সামনেরটা ততক্ষণে জ্বলতে শুরু করেছে। উইলিয়াম স্ত্রীকে পেছনে ধাক্কাতে শুরু করল। ফায়ারকর্মী হিসেবে তার ভালোই জানা আছে, বিমান দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় বিষাক্ত ধোঁয়ায় আক্রান্ত যাত্রীরা। দুই হাত দিয়ে স্ত্রীর মুখ ঢেকে রাখতে চেষ্টা করল সে।
পেছনের নির্গমন দরজার কাছে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল পাওলা। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন তীক্ষ যন্ত্রণা মাথায়। কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। দরজা ভেঙে খুলে গিয়েছিল। যাত্রীরা পাওলার শরীর টপকে বাইরে বেরোতে চেষ্টা করছিল। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল পাওলা। চেষ্টা করছিল দরকারি কথাগুলো মনে করতে, যেগুলো তাদের শেখানো হয়েছিলঃ যাত্রীদের বের করার জন্য তোমার হাতে আছে ৯০ সেকেন্ড সময়, এরপরই ঘটবে বিস্ফোরণ।
নির্গমন পথটাও আগুনে ঢেকে গেছে ততক্ষণে। নিজেকে কোনোভাবে পেছনের দ্বিতীয় নির্গমন দরজার কাছে নিয়ে গেল পাওলা। হ্যান্ডেল টান দিয়ে বুঝল ওটা আটকে আছে। ক্ষীণকায় পাওলা তার সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছিল দরজাটা খুলতে। কিন্তু এক বিন্দুও নড়াতে পারল না। ‘হেল্প মি’ চিৎকার করল সে। একজন এগিয়ে এসে হ্যান্ডেল টেনে ধরলে পাওলা লাথি দিয়ে খুলতে চেষ্টা করল। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল দরজা। ‘গেট-আউট’ এরপরই চিৎকার শোনা গেল তার।
দরজার ওপাশে অন্ধকার আর তুমুল শিলাবৃষ্টি। মিটার তিনেক দূরে স্যাঁতসেঁতে নালা। জরুরি সিঁড়ি বিমান ক্র্যাশের সময় ভেঙে গেছে। ‘ঝাঁপ দাও’ আবারো চিৎকার করল পাওলা।
যাত্রীরা ধাক্কাধাক্কি করে, দলে-পিষে এগোচ্ছিল দরজার দিকে। অনেকে গুঁতা খেয়ে মেঝেতে গড়াচ্ছিল। অন্যরা ওদের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ‘ধাক্কাধাক্কি করো না’ চিৎকার করছিল পাওলা। যারা মেঝেতে গড়াচ্ছিল, তাদের উঠতে সাহায্য করছিল সে। ‘কাউকে মাড়িয়ে দিয়ো না’ পাওলার গলায় আদেশের সুর। তারপর আবার ‘গেট-আউট।’
একে একে প্রায় ২০ জন যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। জোসি ভিভাস, তার তিন মেয়ে বেরিয়ে গেছে, গ্যাব্রিয়েল আর ডায়ানাও বেরিয়ে গেছে। তাদের ঠিক পরেই মনিকা আর উইলিয়াম।
ধোঁয়া আর গ্যাস কুণ্ডলি পাকাতে শুরু করেছে। পাওলা তখনো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। তার প্রায় জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। প্রচণ্ড হুটোপুটির ভেতর দিয়েও আটকে পড়া যাত্রীদের আর্তচিৎকার কানে আসছিল তার। ‘ওরা নির্ঘাত পুড়তে চলেছে’, মনে হলো পাওলার। কিন্তু কালো ধোঁয়া তাকে ছেঁকে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না সে। আর এক মিনিটের মধ্যেই সবাই মারা যাবে, পরিষ্কার বুঝতে পারছিল পাওলা। ‘ক্ষমা করো প্রভু’, ভাবতে ভাবতেই দরজা থেকে ঝাঁপ দিল সে।
বাইরে তখন দোজখের অবস্থা। জঙ্গলের ভেতরে ৪০০ মিটারের একটা পথ করে গেছে বিমান। চারদিকে ভাঙা ডালপালার মধ্যে মানুষের শরীর, লাগেজ আর ক্রু-কেবিনের সিট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একটা স্তূপের নিছে চাপা পড়েছে এক মহিলার অর্ধেক শরীর। পেছনে ছড়ানো তার কাল চুল। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়েছে এক স্টুয়ার্ডের দেহ। কাদা খচতে খচতে এগোচ্ছে বেঁচে যাওয়া হকচকিত যাত্রীরা। বিমানের জানালা গলে তখন লকলকে আগুনের শিখা। গাঢ় ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস।
বিমানের ধাতব গলা তাপ থেকে যারা দূরে সরতে পেরেছিল তারা পড়েছে কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে। আমাজন উপকূলের মতো এখানে বাষ্প নেই বাতাসে। এটা ছিল পেরুর রেইনফরেস্টের উচ্চতম জায়গা। বজ্রবৃষ্টি আর হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার জায়গা এটা। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি। বৃষ্টির পাশাপাশি প্রায়ই নামে শিলাবৃষ্টি। শিলাগুলো প্রায় মার্বেলের মতো বড় বড়।
কোমর সমান কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছিল পাওলাকে। যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে বিমান। ‘দূরে সরে যাও, দূরে’, তখনো চিৎকার করে যাচ্ছিল সে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অনেকেই গুরুতর আহত। ক্ষত থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। আঠালো কাদার মধ্যে জুতা হারিয়ে ফেলেছে অনেকেই। কেটে-ছিঁড়ে গেছে অনেকের পা। ওই অবস্থাতেই উঁচু জমিতে ওঠার চেষ্টা করছিল সবাই। হাঁটতে চেষ্টা করছিল কিন্তু বারবার পড়ে যাচ্ছিল পাওলা। বিমান থেকে ঝাঁপ দেয়ার সময় তার ডান গোড়ালির লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। কাদা থেকে উঠতে না পেরে সাহায্যের জন্য চিৎকার দিল পাওলা। এক যাত্রী অনেক কষ্টে তার হাত আঁকড়ে টেনে নিয়ে এগোতে চেষ্টা করল।
কয়েক মিটার দূরে মনিকাও পা টেনে টেনে এগোচ্ছিল। টি-শার্ট, হালকা ট্রাউজার আর স্যান্ডেল পায়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল সে। মুখের এখানে-ওখানে পোড়া দাগ। এতটাই হকচকিত ছিল যে, ভয় উধাও হয়ে গিয়েছিল তার। মাথায় তখন তার একটাই চিন্তা ঘুরছে‘এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব?’
তার পাশেই আহত হাত দুটো সামনে নিয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছিল উইলিয়াম। স্ত্রীর মুখ বাঁচাতে গিয়ে হাত দুটো মারাত্মক জখম হয়েছে তার। ফোস্কা পড়ে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে, চামড়াও উঠে গেছে এখানে-ওখানে।
কয়েক মিটার দূরে কিছু একটা নজরে পড়ল উইলিয়ামের। জ্বলন্ত বিমানের কাছেই একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর একা একা বসে আছে কালো চুলের ৮-৯ বছরের এক মেয়ে। ‘মা! মা!’ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কেবল মাকে ডেকে চলেছে সে। মমতায় ভিজে উঠল উইলিয়ামের মন। কিন্তু কী-ই বা করতে পারে সে? একজন প্যারামেডিক হিসেবে ডজনখানেক উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে সে। সে জানে কী করতে হবে, কিন্তু ক্ষতবিক্ষত হাত নিয়ে সে কিছুই করতে পারছে না।
‘আমি যাব’ বলল মনিকা।
উইলিয়াম চাচ্ছিল না মনিকা যাক। আশপাশে কেউ আছে? ডাক দিল উইলিয়াম। এগিয়ে এল এক পেরুভিয়ান। ত্রিশের মতো বয়স, গায়ে মেরুন শার্ট। ‘মেয়েটাকে একটু সাহায্য করবে প্লিজ?’ অনুনয়ের সুরে বলল উইলিয়াম। পা টেনে এগিয়ে গেল লোকটি। মেয়েটির দুই হাত জড়িয়ে নিল নিজের গলায়। আশপাশটা একবার জরিপ করল মনিকা আর উইলিয়াম। বেঁচে যাওয়া কাউকে দেখা যায় কি না। ‘কারো কি সাহায্য দরকার?’ দুজনই চিৎকার দিল। কোনো উত্তর অবশ্য এল না।
কিন্তু কিছু একটা কানে এল গ্যাব্রিয়েল ভিভাসের। ‘কিসের শব্দ ওটা?’ তার কণ্ঠে জিজ্ঞাসা। সে আর তার পরিবারের সবাই বিমান থেকে বেরোতে পেরেছিল। নালার মধ্যে মনিকা আর উইলিয়ামদের পাশাপাশিই হাঁটছিল তারা। পেছনে কিছু একটা শুনতে পেয়েছে গ্যাব্রিয়েল। আগুনের কাছাকাছি জায়গা থেকে আসছে শব্দটা। পাঁচ সন্তানের পিতার কখনো এ শব্দ চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। শিশুর গলা এটা। পেছন ফিরে শিশুটাকে কাদার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখল উইলিয়াম।
‘কোথায় যাচ্ছ?’ জানতে চাইল ডায়ানা।
‘ওই শিশুটাকে নিয়ে আসি’, হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিল গ্যাব্রিয়েল।
প্রচণ্ড আতঙ্ক গ্রাস করেছে ডায়ানাকে। বিস্ফোরণ হলেই নির্ঘাত মারা পড়বে তার স্বামী। অনুনয় করল যেন সে না যায়। ‘কিছু হবে না’ দৃঢ় ভঙ্গিতে আগুনের ধ্বংসস্তূপের দিকে এগোতে এগোতে জবাব দিল উইলিয়াম। ভয় অবশ্য তারও লাগছিল। জায়গাটা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা তার কল্পনাতেও আসেনি। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে কয়লা হয়ে ছড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে। শিশু না হলে সে ঘুরে দৌড় দিত এ জায়গা ছেড়ে নির্ঘাত।
ভয়াবহ এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এক বছরের শিশুটাকে দেখতে পেল গ্যাব্রিয়েল। কোনোমতে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল শিশুটা। চেহারার এখানে-ওখানে কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। শরীরে অসংখ্য পোড়া দাগ। আরেকজন যাত্রীও এগিয়ে এসেছে শিশুটাকে বাঁচাতে। খুব দ্রুত কাজ করতে হবে তাদের।
গ্যাব্রিয়েলের কনুই আর নিজেরটা মিলিয়ে চামচের মতো শিশুটাকে তুলে আনল। কিন্তু কয়েক পা এগোতেই কোমর সমান কাদার গর্তে পড়ে গেল সে। শিশুটাকে তার কাছে ছেড়ে দেয়ার জন্য হাত দিয়ে লোকটাকে ইশারা করল গ্যাব্রিয়েল। এক হাতে শিশুটাকে ধরে অন্য হাতে লোকটাকে টানতে লাগল সে।
শিশুটাকে নিয়ে একটা পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল গ্যাব্রিয়েল। কাঁটাঝোপ সরিয়ে পথ করে দিচ্ছিল সাথের লোকটি। কাদা খচে এগোতে এগোতে গ্যাব্রিয়েলের মনে হচ্ছিল শিশুটা নির্ঘাত কোলেই মারা যাবে। ‘প্লিজ প্রভু! শিশুটাকে মরতে দিয়ো না’, মনে মনে বলল সে।
প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন ডায়ানা ভিভাসও প্রার্থনা করে চলেছে। জ্বলন্ত বিমানের মিটার ৪৫ দূরে একটা ফাঁকা মতো জায়গায় ভিভাস পরিবারের অন্যদের নিয়ে অপেক্ষা করছে সে। মেয়েরা কাদার মধ্যে তাদের জুতা হারিয়ে ফেলেছে। কান্নাকাটি করছে এখনো। কেন বিমান ক্র্যাশ করল? কখন বাড়ি যাব আমরা? অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল ডায়ানাও। ‘গ্যাবি! গ্যাবি!’ গ্যাব্রিয়েলকে নিজেদের অবস্থানটা জানান দেয়ার চেষ্টা।
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে পাওলা চু। ডান পা ফুলে দ্বিগুণ মোটা হয়ে গেছে। বাম পা-টাও রক্তাক্ত। এক চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে আছে। সারা মুখ থ্যাতলানো। ক্র্যাশের ঠিক পরপরই এড্রেনালিনের প্রভাব তাকে দায়িত্বে ঠেলে দিয়েছিল ঠিক। কিন্তু একটু অবসর পাওয়ায় আবেগ ঘিরে ধরল তাকে। সহকর্মীদের কী অবস্থা? ‘ক্রুদের বাকিরা কোথায়?’ এক স্টুয়ার্ডকে জিজ্ঞেস করল সে। ‘ওরা সবাই শেষ’, বন্ধুর জবাব। চোখে অশ্র“র প্রবাহ টের পেল পাওলা। সামনের কেবিনে দায়িত্ব থাকলে সেও মারা যেত নির্ঘাত। কিন্তু এখন যে তাকে শক্ত হতে হবে। কাজ এখনো বাকি।
ঠিক তখনই সামনের ঝোপটাতে নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া গেল। কাদায় আকীর্ণ একজন ঝোপ ঠেলে এগিয়ে আসছে। পরিশ্রমে অবসন্ন চেহারায় কোলে শিশু নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এল গ্যাব্রিয়েল। শিশুটাকে সাবধানে নামিয়ে রেখে ভাই জোসিকে ডাকল সে। ‘সবাইকে স্প্যানিশে বলো এখানে গোল হয়ে দাঁড়াতে। শিশুটাকে শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচাতে হবে।’ তখনই শোনা গেল দ্বিতীয় বিস্ফোরণের শব্দ। আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়ছিল গাছের মগডাল পর্যন্ত। সেই আগুনে ঢাকা পড়ল বিমানের বাকিটুকুও।
তারা যেখানে ছিল, জায়গাটা খুবই বিপজ্জনক। পাওলা চাচ্ছিল সবাইকে আরো উঁচুতে নিয়ে যেতে। তারপর সাহায্য খুঁজতে হবে। দুজন যাত্রী তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। সবাইকে এক সাথে থাকতে বলল পাওলা। বলল বিমান থেকে আরো দূরে সরে যেতে হবে। ‘শান্ত হও। সামনে হাঁটো’, সবাইকে বলল সে। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত, ভেজা কাপড় নিয়ে কাঁপছে ঠকঠক করে। ওভাবেই পা বাড়াল সবাই। নিজের জুতা খুলে স্ত্রীর পায়ে পরিয়ে দিল গ্যাব্রিয়েল। শিশুটাকে কোলে নিয়ে শুধু মোজা পায়ে হাঁটছিল সে। পাওলাকে নিয়ে এগোচ্ছিল আরেকজন। তখনো বৃষ্টি চলছে। বজ্রপাতও হচ্ছে থেমে থেমে।
বিকেল ৪টার কিছু পরে কাছাকাছি গ্রামের দুজন মানুষকে প্রথম তাদের দিকে আসতে দেখল বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা। মিনিট কয়েক পর নজরে এল গাড়ির হেডলাইট। একে একে আহত যাত্রীদের গাড়িতে করে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল। অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা তখনই চোখে পড়ল গ্যাব্রিয়েল আর জোসির। যাকে দেখার জন্য এতটা পথ পার হয়ে আসা, তাদের সেই বাবা সামনে হাজির। ৬৭ বছরের এই বৃদ্ধ বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন। বিমান ক্র্যাশের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন। বাবা আর ছেলেরা পরস্পরকে জাপটে ধরল।
২০৪ নম্বর ফ্লাইটে যাত্রী আর ক্রু মিলে মারা গিয়েছিল ৪০ জন। বাঁচতে পেরেছিল ৫৮ জন। পেরু সরকার তদন্তে দেখেছে বিমান ক্র্যাশের দায়টা আসলে ছিল পাইলটের। প্রচণ্ড ঝড়ের ভেতর বিমান ল্যান্ড করাতে গিয়েই দুর্ঘটনাটা ঘটে। লিমা হাসপাতালে ৪০ দিন থাকতে হয়েছিল পাওলাকে। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, মাথায় জমাট রক্ত আর ছেঁড়া লিগামেন্ট তাকে ভুগিয়েছে দারুণ। জুয়ান কার্লোস ভ্যালে নামের শিশুটাকে পোড়া চামড়া আর মাথার খুলিতে ফ্র্যাকচারের চিকিৎসা দেয়া হয়। তার আহত মা বাঁচতে পারেনি। পরে তার বাবা এসে তাকে নিয়ে যায়। তার বাবা অবশ্য বিমানে ছিল না।
লিমায় পোড়া চামড়ার চিকিৎসা নিতে নিতে কাটে মনিকা আর উইলিয়ামের হানিমুনের সময়টা। মনিকা দ্রুত সুস্থ হলেও উইলিয়ামের হাত সারতে সময় নিচ্ছে বেশ। অনেক মাস গেছে, এখনো গ্লাভস ব্যবহার করতে হয় তাকে। ভিভাস পরিবারের সদস্যদের কেউ তেমন গুরুতর আহত হয়নি। নিউইয়র্কে ফিরে যাওয়ার পর ব্র“কলিনের স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান ‘ভিভাস ফ্যামিলি ডে’ ঘোষণা করেছেন। দারুণ বিপদের সময় সাহসিকতা আর মানসিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য ভিভাস পরিবারের সম্মানে উদযাপিত হবে এই দিন।
সব শেষ। আতঙ্ক তবু যেন কাটতে চায় না। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের তীক্ষ্ শব্দে এখন চমকে ওঠে গ্যাব্রিয়েল। ভিড়-জটলা পুরোপুরি এড়িয়ে চলে জোসি। দ্রুত গাড়ি ড্রাইভেও তার ভয়। দুঃস্বপ্ন এখনো তাড়া করে ফেরে ডায়ানাকে। ওদিকে স্থায়ী বিষন্নতায় পেয়ে বসেছে পাওলাকে।
বিমান দুর্ঘটনার পর বিয়ের ব্যাপারে নতুন ভাবনা জন্মেছে মনিকার। ‘সুসময়ে কারো সাথে থাকাটা খুবই সহজ’, বলছিল সে। ‘কিন্তু দুর্ঘটনায় সব কিছুর পরীক্ষা হয়ে গেছে। পছন্দে আমি ভুল করিনি।’
খবর বিভাগঃ
আন্তর্জাতিক
দুর্ঘটনা
0 facebook: