সরকারি
চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে মাঠে নেমেছে
ছাত্রলীগের এক ঝাঁক অনুপ্রবেশকারী। নিজেকে দলের অনুগত প্রমাণে মিথ্যা প্রচারণায়
নেমেছে তারা। ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতাদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ কাজ করছেন তারা। এক্ষেত্রে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
ফেসবুক প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। তৈরি করছে নতুন নতুন প্রোপাগান্ডা।
সূত্র
জানায়,
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবগুলো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ
শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার প্রত্যয়
ব্যক্ত করেন তারা। ছাত্রলীগের আসন্ন সম্মেলন বানচালের উদ্দেশ্যে এতে ইন্ধন দেয়
সংগঠনটিও। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে গেলে ভোল পাল্টায়
ছাত্রলীগ। নিজেদের ইমেজ ফিরিয়ে আনতে তারাই আবার আন্দোলনকারীদের বিরোধীতায় নামে।
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, কোটা সংস্কার
আন্দোলনে হলগুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামে। যৌক্তিক দাবির পক্ষে
নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করতে হল ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নির্দেশও
উপেক্ষা করেন তারা। সাধারণ ছাত্রদের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনশূন্য স্থানগুলোতে
অবস্থান নেয় কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ
কেন্দ্রীয় নেতারা। এমন অবস্থায় দলে গ্রহণযোগ্যতা যখন তলানিতে, তখন নিজেদের ইমেজ ফিরিয়ে আনতে তারা আন্দোলনকারীদের ছাত্রদল
ও শিবির বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।
ছাত্রলীগ
সূত্র জানায়, আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে
শুরুতেই তারা টার্গেট করে ‘বাংলাদেশ
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ এর ৪ নেতাকে। এর সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাদের নামে অত্যাধুনিক কিছু
সফটওয়্যার ব্যবহার করে শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেখিয়ে স্ক্রিনশট বানিয়ে ছড়িয়ে
দেওয়া হয়। আর এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় দু’টি ফেসবুক গ্রুপ। গ্রুপ দু’টি হলো- ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সাইবার জোন’ ও ‘গুজবে কান দেবেন
না’। এ দু’টি গ্রুপকে
প্রোপাগান্ডা ছাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় তারা।
এদিকে
এই গ্রুপ দু’টিতে গিয়ে
দেখা যায়,
এখানে যারাই অতি উৎসাহী ভূমিকায় আছে তাদের অধিকাংশই
ইতোপূর্বে ছাত্রদল ও শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। আসন্ন ছাত্রলীগের সম্মেলনকে
সামনে রেখে নিজের কলঙ্ক ঢাকতে গ্রুপটিতে অতি উৎসাহী ভূমিকায় রয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দ্ব›দ্বকে কাজে লাগিয়ে কারও ওপর ক্ষোভ ঝারতেও ব্যবহার করা হচ্ছে গ্রুপটিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক ও নারীদেরকেও
প্রকাশ্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে এই গ্রুপ দু’টি থেকে।
গ্রুপে যারা অতি উৎসাহী ভূমিকায় রয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজনের
অনুপ্রবেশের তথ্য পাওয়া গেছে। যারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের বিরুদ্ধে
অথবা দলের সঙ্গে আদর্শিকভাবে যায় না এমন সব কথা বলেছেন। অনেকে আবার নানা জিহাদী
পোস্টও দিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন- ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দেব নন্দী।
যার বিরুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফরিন নুসরাতের সঙ্গে অবৈধ
সম্পর্ক গড়ে গর্ভবতী করার অভিযোগ রয়েছে।
গ্রুপে সক্রিয় রয়েছেন আফরিন নুসরাতও। আফরিন নুসরাত এর আগে সাবেক
ছাত্রলীগ নেতা কামরুল হাসান খোকনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাদের বিভিন্ন
আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ঠোটে চুমু খাওয়ার
কয়েকটি ছবি বেশ আলোচিত হয়। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের সেই নেত্রীকেই বিয়ে করেন
স্বোচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা খাইরুল হাসান
জুয়েল।
রয়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা’ সূর্যসেন হলের
ইয়াবা সম্রাট বেনজির আহমেদ। এর আগে যিনি ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয়
ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে সে ছাত্রলীগে
সক্রিয় হয়। ইয়াবাসহ তেজগাও থানা পুলিশ তাকে আটক করে। বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পাসে
তোলপাড় হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান গিয়ে তাকে
তেজগাও থানা থেকে উদ্ধার করেন।
রয়েছে
বর্তমান ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার শাহজাদা। যিনি ইতোমধ্যে বিয়ে করেছেন এবং
তার একটি সন্তান আছে বলে জানা যায়। এছাড়া দেলোয়ার এক সময়ে শিবিরের রাজনীতিতে
সক্রিয় ছিল। আরও আছেন এফ এইচ হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমান।
পারিবারিকভাবে বিএনপি-জামাতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মশিউর শুরুতে সক্রিয়ভাবে কোটা
সংস্কার আন্দোলন করেন। পরে আন্দোলন স্থগিত হলে শরীফ অবস্থান পরিবর্তন করে
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পোস্ট দিতে থাকেন।
কুমিল্লার এক সময়ের দাপুটে শিবির নেতা আবু ইউনুসও সক্রিয়
রয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে। ২০১১ সালে সে শিবিরের থানা পর্যায়ের বায়তুলমাল সম্পাদক
ছিল। পরে ছাত্রসেনার সাথে জড়িয়ে পরে। সে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আদর্শ পরিবর্তন করে ছাত্রলীগে যোগ দেয়। বর্তমানে সে বিজয়
একাত্তর হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার রাজনীতিতে অন্যতম প্রদর্শক কুমিল্লার
নিজামুল হক দিদার। যিনি বর্তমানে ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। উল্লেখ্যঃ দিদারও
এক সময়ে ছাত্রদল-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল।
‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সাইবার জোন’ গ্রুপের এডমিন ও জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসিফ
তালুকদারও এ আন্দোলন বানচালে বেশ তৎপর। আসিফ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে
ছাত্রদলের নেতৃত্ব দিত। বর্তমান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-সম্পাদক রোমানসহ কয়েকজনের
দায়িত্ব ছিল জহুরুল হক হলে ছাত্রদলকে সংগঠিত করা। শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিল এস এম হল
ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল ও মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি জহিরুল
ইসলাম। এছাড়া মুহসিন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানি, যিনি ক্যাম্পাসে ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক- সেও আগামী
কমিটিতে পদ পেতে বেশ তৎপর। এছাড়া জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সভাপতি সোহানুর রহমান
একসময় ছাত্রদলের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিল। ছাত্রদলের কয়েকটি কর্মসূচীতে যোগ
দেওয়ার ছবিও রয়েছে তার।
এছাড়া
সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার সারো এর আগে শিবির ও ছাত্রদল করতেন।
ক্যান্টিনেও ফাও খান তিনি। ২০১৩ সালের ১৪ই মে তিনি শিবিরের পক্ষ নিয়ে একটি
স্ট্যাটাস দেন। যেখানে শিবির সভাপতিকে নিয়ে তিনি লেখেন, ‘শিবির সভাপতি দেলোয়ারকে বারবার রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। তথ্য
নেওয়ার জন্য রিমান্ডে নেওয়া ঠিক আছে। কিন্তু দেখলা তাকে টর্চার করে পঙ্গু করে
দেওয়া হয়েছে। একটা দলের প্রধানকে এভাবে পঙ্গু করে দেওয়া কতটুকো যৌক্তিক। যেই
স্ট্যাটাসে ১৪৯ জন লাইক দেয় এবং ১৪ জন শেয়ার করে।
আরও
রয়েছেন- ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি। যিনি বর্তমান
আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী। লিলি ছাত্রলীগের ‘নষ্ট নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকাকালীন গভীর রাতে হালকা শড়ি পরে
তাকে হলে ফিরতে দেখা যেতো। বিভিন্ন দামি গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে দেওয়া হতো বলেও
জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এছাড়া
বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় রয়েছেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম এহতেশাম। যিনি
একাধিক নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত। আছেন কলা অনুষদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক
মির্জা নূর। নূর এলাকায় ছাত্রদল করতো। পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের
সভাপতি আবিদ আল হাসানের হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু হল
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল অমিন রহমান বেশ সক্রিয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে
বিতর্কিত করতে। আল আমিন ইতোপূর্বে জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদক
পর্যায়ের নেতা ছিল।
কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী এনায়েতকেও দলের বিরোধী অবস্থানে দেখা গেছে। ২০১৩ সালের ৭
মে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন- ‘৫ই মে হেফাজতে ইলামের নিরীহ কর্মীদের ওপর পরিচালিত হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা
জানাই। আমি ছাত্রলীগ করলেও সরকারের এই নীতিকে সমর্থন করতে পারিনা। বঙ্গবন্ধু
আমাদের মানবতা শিখিয়েছেন, নিষ্ঠুরতা নয়’।

এছাড়া ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। তবে বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারেনি।
এছাড়া ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। তবে বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু
হল ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি
হাসিব মীর এক সময়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিল। ছাত্রদল করার অভিযোগে
বঙ্গববন্ধু হলে থাকাকালীন তৎকালীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াদ
তাকে পোস্ট দিতে চাননি। হাসিব মীর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন- ‘মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই।
ভোট না পেয়ে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় কি?’ সেও এখন কোটা সংস্কার বিরোধী প্রচারণায় বেশ সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে।
তবে
ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান রনি, আদিত্য নন্দী, সোহানুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান, শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক গোলাম রব্বানীসহ ছাত্রলীগের
একটি অংশ যুক্তি দিয়ে দলের পক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরছেন। তারা কোটা সংস্কার
বিষয়ে দলের অবস্থান জানান দিয়ে নানা ইতিবাচক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন। যা
ইতোমধ্যেই বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
খবর বিভাগঃ
ক্যাম্পাস
0 facebook: