18 December 2018

ভারত থেকে যেভাবে ৪৫ লাখ কোটি ডলার চুরি করে ব্রিটেন

সংগ্রহীত ছবি
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ব্রিটেনের পক্ষ থেকে বলা হতো ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন তাদের জন্য একটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাএখান থেকে তারা উল্লেখযোগ্য কোনো আর্থিক সুবিধা তো পায়নি, উপরন্তু এটি তাদের খরচের একটি খাত হিসেবেই ছিলব্রিটেনের এ বক্তব্যের মাধ্যমে এই উপমহাদেশের প্রতি তাদের অনুগ্রহ করার একটি ভাব ছিল

কিন্তু কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অর্থনীতিবিদ উষা পটনায়েকের সদ্য প্রকাশিত একটি গবেষণা ওই মিথের ওপর বড় ধরনের একটি আঘাত হেনেছেকারণ তাতে কর ও বাণিজ্য সম্পর্কিত দুই শতাধিক নথির উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত এ সময়ে ব্রিটেন ভারতবর্ষ থেকে প্রায় ৪৫ লাখ কোটি ডলার লুট করে নিয়ে যায় যা বর্তমানে ব্রিটেনের মোট জিডিপির ১৭ গুণ

কিভাবে এ চুরি করা হয়?
মূলত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কূটবুদ্ধির ফলেই এটি সম্ভব হয়েছিলপ্রথম দিকে তারা স্বাভাবিকভাবে ভারতের উৎপাদকদের কাছ থেকে রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে পণ্য কিনতকিন্তু ১৭৬৫ সালের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো ভারতবর্ষের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়ার পর তাদের পদ্ধতি পাল্টে যায়তারা ভারতবাসীদের কাছ থেকে কর নিত, আবার সেই করের টাকা দিয়ে ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশরা ভারতীয়দের কাছ থেকে পণ্য কিনতএর ফলে তারা আসলে ভারতবাসীদের কাছ থেকে ফ্রিতেই পণ্য নিতএটি বড় আকারের চুরি হলেও যেহেতু কর আদায়কারী ও পণ্যক্রয়কারী গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন ছিল, তাই কেউ বিষয়টি ধরতে পারেনি

চুরি করা এসব পণ্যের কিছু ব্রিটেনেই ব্যবহৃত হতোআর বেশির ভাগই অন্যত্র পুনঃরফতানি করা হতোব্রিটেনের শিল্পায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য লোহা, আলকাতরা ও কাঠ ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইউরোপে অর্থপ্রবাহ বজায় রাখতে সেখানে পুনঃরফতানির বিষয়টি অনুমোদন করে দেশটিবস্তুত ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের একটি বড় অংশ ভারতবর্ষ থেকে নেয়া চুরির ওপরই নির্ভরশীল ছিলএভাবে চুরি করা, সেই পণ্য অন্যত্র বিক্রি ইত্যাদির মাধ্যমে তারা শুধু পণ্যের ১০০% মূল্যই পকেটে ভরতো তা নয়, উপরন্তু তার মুনাফাও গ্রাস করত

১৮৪৭ সালে ব্রিটেনের রাজা ভারতবর্ষের দায়িত্ব নেয়ার পর তারা কর ও বাণিজ্যের নতুন একটি পদ্ধতি চালু করেতাতে বলা হয়, ভারত থেকে কেউ কিছু কিনতে চাইলে তাকে শেষ পর্যন্ত লন্ডনেই লেনদেন শেষ করতে হবেকারণ আমদানিকারক দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে দায় শোধ করতে হতো কাউন্সিল বিলের মাধ্যমে, যা কেবল ব্রিটিশ রাজাই ইস্যু করতেন এবং লন্ডন থেকে স্বর্ণ বা রূপার বিনিময়ে তা কিনতে হতোআমদানিকারকেরা ভারতে সেই কাউন্সিল বিল দিয়েই পণ্য কিনত

ভারতীয়রা যখন সেই বিল ক্যাশ করতে চাইতো তখন তাদের তা ক্যাশ করে দেয়া হতো করের রুপি দিয়েই, যা তাদের কাছ থেকেই কর আকারে নেয়া হয়েছিলফলে আসলে তাদের কোনো অর্থ দেয়া হতো নাতাদের সাথে কেবল প্রতারণাই করা হতোফলে সে স্বর্ণ বা রৌপ্য আসলে ভারতীয়দের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল, তা শেষ পর্যন্ত লন্ডনে গিয়েই জমা হতো

এ অবস্থার সাধারণ জবাব দিতে গিয়ে কোনো কোনো সময় ব্রিটেনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, ভারত ব্রিটেনের নিকট দায়বদ্ধ ছিলকিন্তু আসলে ঘটনা ছিল তার উল্টোভারতবর্ষ থেকে এভাবে অর্থ লন্ডনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণেই ভারতীয়রা ব্রিটেন থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়এ অপ্রয়োজনীয় ঋণ দিতে পেরে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী হয়

ভারতবর্ষ থেকে নেয়া এসব অর্থ তারা বিভিন্ন আক্রমণ, অভিযান, শত্রুপক্ষকে ঠেকানোর কাজেও ব্যবহার করত১৮৪০ সালে চীনের আক্রমণ, ১৮৫৭ সলে ভারতে বিদ্রোহ দমনসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রে এ খাত থেকেই অর্থ খরচ করা হয়েছেএ ছাড়া যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রেই ভারতের করদাতাদের কর দিতে বাধ্য করা হতোপটনায়েক এ বিষয়ে বলেন, ভারতের সীমান্তের বাইরে ব্রিটেনের যেকোনো যুদ্ধে পুরোপুরি বা অধিকাংশেই ভারত থেকে আহরিত রাজস্বই ছিল তাদের ভরসাআবার ইউরোপে পুঁজিবাদ বিস্তারে খরচসহ বিভিন্ন দেশে শিল্পায়নে এসব উপনিবেশের অর্থই ব্যবহৃত হতোপটনায়েক ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সময়কে চার ভাগে ভাগ করে দেখেছেন, এভাবে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটেন যে অর্থ নিয়ে গেছে, তার পরিমাণ ৪৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার

যদি ভারতবর্ষ তাদের নিজেদের কর ও বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্থগুলো নিজেদের উন্নয়নে ব্যয় করতে পারত, যেমনটি করেছে জাপান, তাহলে এ অঞ্চলের ইতিহাস অন্যরকম হতো পারতদারিদ্র্য, কষ্ট দূর করে হয়তো পরিণত হতো পারত অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে

কিন্তু ব্রিটিশরা ওই বিষয়গুলো এখনো স্বীকার করতে চায় নাবরং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছিলেন, ব্রিটিশদের এ শাসন ছিল ভারতবাসীদের জন্য একটি নিঃখরচার সাহায্যঅথচ ২০১৪ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল, ৫০ শতাংশের বেশি ব্রিটিশ মনে করে এসব উপনিবেশবাদ উপনিবেশগুলোর জন্য কল্যাণকর ছিল

তবে সত্য হচ্ছে, ব্রিটিশদের ২০০ বছরের ভারত শাসনে মাথাপিছু আয় বাড়েনি, গড় আয়ু বাড়েনিবরং দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ লোক মারা গিয়েছিলতাই পটনায়েক বলেন, ব্রিটেন ভারতের উন্নয়ন ঘটায়নি, বরং ভারতবর্ষই ব্রিটেনকে উন্নত করেছেতাহলে এখন ব্রিটেনের কী করা উচিত? ক্ষমা চাওয়াঅবশ্যইআর ক্ষতিপূরণ দান? সম্ভবত পুরো ব্রিটেনেরও সেই অর্থ পরিশোধ করার সামর্থ্য নেইসূত্রঃ আলজাজিরা


শেয়ার করুন

0 facebook: