স্টাফ রিপোর্টার।। রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোর আয়ের অর্থ তিনভাবে পাচার হচ্ছিল বিদেশে। এমনই তথ্য পাওয়া গেছে ঢাকার ক্যাসিনো মালিকদের রাজনৈতিক সহযোগীদের কাছ থেকে।
প্রথমত, ক্যাসিনোগুলোয় কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা তাঁদের বেতন ও অংশীদারি থেকে পাওয়া অর্থ নিজ দেশে পাচার করতেন। দ্বিতীয়ত, ক্যাসিনোগুলোর একাধিক মালিক নিয়মিত সিঙ্গাপুর, দুবাই, ব্যাংককে গিয়ে জুয়া খেলে ওড়াতেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। তৃতীয়ত, ক্যাসিনোর আয়ের টাকা পাচার করা হতো বিদেশে অবস্থানকারী সরকারের তালিকাভুক্ত একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে।
জানা গেছে, ঢাকার ক্যাসিনোগুলোয় অংশীদারির ভিত্তিতে কাজ করেন ৯ জন নেপালি। ক্যাসিনো পরিচালনায় অভিজ্ঞ এসব নেপালিদের বিভিন্ন দেশে ক্যাসিনো রয়েছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করছে তারা।
অংশীদারির ভিত্তিতে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী ৯ নেপালি উগ্রহিন্দু নাগরিকের নাম পাওয়া গেছে। ২০১৫ সাল থেকে এঁরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছে। এই ৯ নেপালি নাগরিক হচ্ছে বিনোদ মানালী, অজয় পাকরেল, দীনেশ, রাজকুমার, প্রদীপ ওরফে সুরেশ, হেলমি, কৃষ্ণা থাপা, মালকি ও ছোট রাজকুমার। এঁরা সবাই ঢাকায় ক্যাসিনোর অংশীদার।
এ ছাড়া নেপালের আরো প্রায় ২০ জন নাগরিক ঢাকার ক্যাসিনোগুলোতে কাজ করে। এঁদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন এক হাজার ডলার বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলে, যুবলীগ যে ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে তাতে শেখ হাসিনা ছাড়া কারো পক্ষেই তাদের সামলানো কঠিন। সম্রাটের অফিসের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ মিলবে।
সিঙ্গাপুর, দুবাই, ব্যাংকক ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে জুয়া খেলেন ঢাকার একাধিক যুবনেতা। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, বেশ কয়েকজন যুবনেতার প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার বিদেশ গমনের রেকর্ড রয়েছে।
ওই সব নেতার পাসপোর্ট তল্লাশি করলে এই সত্যতা পাওয়া যাবে। এঁদের বেশির ভাগের গন্তব্য সিঙ্গাপুর, দুবাই, ব্যাংকক ও মালয়েশিয়া। এঁদের অনেকের ব্যাবসায়িক কম্পানি আছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়।
এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি সম্রাট, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ, সহসভাপতি আরমানুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুইয়া, জামাল, সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মিজানুর রহমান মিজান, সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। যুবলীগের আরো কয়েকজন আছে যাঁরা মাঝেমধ্যেই বিদেশ যায়।
সূত্র জানায়, ঢাকার মতিঝিলপাড়ার স্পোর্টিং ক্লাবগুলোয় জুয়ার আসর বসানো দীর্ঘদিনের পুরনো ঘটনা। আধুনিক জুয়ার আসর ক্যাসিনোর বিপ্লব ঘটে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের হাত ধরে ২০১৫ সাল থেকে।
টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে ঢাকার যুবনেতাদের হাতে বিপুল অর্থ জমলে তাঁরা জুয়া খেলতে সিঙ্গাপুর যাওয়া শুরু করে। ওই সময় সম্রাট ও মোমিনুল হক সাঈদের পরিচয় হয় ক্যাসিনো পরিচালনায় অভিজ্ঞ কয়েকজন নেপালি নাগরিকের সঙ্গে।
এর পরই সম্রাট দেশে ক্যাসিনো আনার উদ্যোগ নেয়। তবে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সম্রাট ক্যাসিনো আনার কয়েক মাস আগেই ঢাকার ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ক্যাসিনো নিয়ে আসে ওই ক্লাবের সভাপতি কাজল এবং সাধারণ সম্পাদক তুহিন।
নেপালি নাগরিক রাজকুমার ও বিনোদ মানালী ওই ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। কয়েক মাস পরে ক্লাব কর্তৃপক্ষ রাজকুমার ও বিনোদ মানালীর কাছে দিনপ্রতি এক লাখ ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে ক্যাসিনোটি ভাড়া দিয়ে দেয়।
এ ঘটনার পরই সম্রাট তার দলবল নিয়ে ভিক্টোরিয়া ক্লাবে হানা দেয়। ওই সময় কিছুদিন ক্যাসিনোটি বন্ধ থাকে। পরে সম্রাটকে প্রতিদিন চার লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আবার ক্যাসিনোটি চালু হয়। যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমান ও খোরশেদ প্রতিদিন ওই টাকা সংগ্রহ করে সম্রাটকে দিত।
ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ক্যাসিনো চালুর কয়েক মাস পরই মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে সংযোজন হয় ক্যাসিনোর। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে ক্যাসিনোর মূল মালিক ইসমাইল হোসেন সম্রাট হলেও কাগজপত্রে আলী হোসেন নামে একজনের নাম রয়েছে। জানা যায়, এই আলী হোসেন একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী।
সূত্র জানায়, আয়ের অংশ থেকে প্রতিদিন সম্রাটকে দেওয়া হতো পাঁচ লাখ টাকা। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবও অংশীদারির ভিত্তিতে পরিচালনা করত নেপালি নাগরিক দীনেশ ও রাজকুমার। তাঁদের অংশীদারি ছিল ৩৫ শতাংশ।
বনানীর গোল্ডেন ক্লাবে ক্যাসিনোর সূচনা করে দুজন ব্যবসায়ী। আবদুল আওয়াল ও আবুল কাশেম। এই ক্যাসিনো চালুর খবর সম্রাটের কাছে পৌঁছালে সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ক্লাবটি সিলগালা করিয়ে দেয়।
দুই মাস বন্ধ থাকার পর সম্রাটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আবার চালু করা হয় ক্যাসিনোটি। চুক্তি হয় প্রতিদিন সম্রাটকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এরপর ক্লাবটির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিতে সম্রাট দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি আরমানকে ক্লাবটির মালিকানায় ঢুকিয়ে দেয়।
ক্লাবটি থেকে প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা সম্রাটের কাছে পৌঁছে দিত আরমান। ক্লাবটির ক্যাসিনো পরিচালনা করত নেপালি নাগরিক অজয় পারকেল।
স্বেছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার ও দক্ষিণ যুব লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনা করত নেপালি নাগরিক হেলিমি। ওই ক্লাব থেকে সম্রাটকে কোনো টাকা দিতে হতো না।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার ফুওয়াং ক্লাবে ক্যাসিনো চালু কর নুরুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী। তেজগাঁও জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ক্যাসিনোটি বন্ধ হয়ে যায়।
পরে ইসমাইল হোসেন সম্রাটের মধ্যস্থতায় আবারও চালু করা হয় ক্লাবটি। এই ক্লাব থেকে সম্রাটকে প্রতিদিন দুই লাখ টাকা করে চাঁদা দেওয়া হতো। নুরুল ইসলাম পুরস্কারঘোষিত এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর আত্মীয়।
আরামবাগ ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দক্ষিণ যুবলীগের নেতা জামাল ও দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ। তবে এঁদের মূল হোতা হচ্ছে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। আয়ের বড় অংশ নিয়ে নিত সে।
সূত্র জানায়, আরামবাগ ক্লাব থেকে দিনপ্রতি সম্রাটের সেলামি ছিল দুই লাখ টাকা। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের নেতা ইমরান ক্যাসিনো চালু কর মোহামেডান ক্লাবে।
ওই ক্লাবে ৪০ শতাংশ অংশীদারিতে ক্যাসিনো পরিচালনা করত নেপালি নারী কৃষ্ণা থাপা। এই ক্লাব থেকে সম্রাটের হয়ে প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করত তাঁর ক্যাশিয়ার আরমান।
শতকরা ৪০ ভাগ অংশীদারিতে দিলকুশা ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করত নেপালি নাগরিক দীনেশ, সুরেশ ও ছোট রাজকুমার। ওই ক্লাব থেকে প্রতিদিন ছয় লাখ টাকা নিত সম্রাট।
খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ইয়ংমেনস ক্লাবের সঙ্গে কোনো নেপালি নাগরিকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া একসঙ্গে আরো দুটি ক্লাবের ক্যাসিনো চালাত। আরামবাগ ক্লাবে তাঁর অংশীদার ছিলেন যুবলীগ নেতা জামাল ও মোমিনুল হক সাঈদ।
অন্যদিকে মেরিনার্স ক্লাবে খালেদের অংশীদার ছিল নেপালি নাগরিক প্রদীপ ওরফে সুরেশ। এলিফ্যান্ট রোডের এজাক্স ক্লাবে ক্যাসিনো শুরু করে সম্রাটের ক্যাশিয়ার যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমান, তছলিম ও খোরশেদ।
নেপালি নাগরিক ছোট রাজকুমার ওই ক্লাবের ৪০ শতাংশের অংশীদার। এই ক্লাব থেকে সম্রাটকে প্রতিদিন দেওয়া হতো তিন লাখ টাকা করে।
নেপালি নাগরিক ছোট রাজকুমার ও মালকিকে ৩০ শতাংশ অংশীদারি দিয়ে রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে ক্যাসিনো চালু করে স্থানীয় যুবলীগ নেতা তছলিম।
ক্যাসিনোসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন বলে, প্রতি রাতে ঢাকায় ক্যাসিনোগুলোতে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার জুয়া খেলা হতো। এর মধ্যে মালিকদের লাভ থাকত গড়ে ৫০ কোটি টাকা।
ওই লভ্যাংশ থেকে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদা দেওয়ার পরও নেপালি নাগরিকদের কাছে চলে যেত প্রায় ৪০ শতাংশ। নেপালিদের ক্যাসিনোর অংশীদারি এবং ক্যাসিনোতে চাকরি করতে আসাদের বেতন বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে দেশের বাইরে চলে যেত।
গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের জানিয়েছে, ক্যাসিনোর আয়ের বড় একটি অংশ সে বিদেশে অবস্থানকারী একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে পাঠাত।
ওই সব শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করা জিসানের নাম বলেছে খালেদ।
এ ছাড়া ক্যাসিনোসংশ্লিষ্ট একাধিক যুবলীগ নেতা নিয়মিত সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও দুবাই গিয়ে জুয়া খেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ উড়িয়ে আসত। দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের চীনা বান্ধবী মিন্ডি লির জন্মদিন পালনের বিষয়টি বহুল আলোচিত ঘটনা।
শুধু সম্রাট নয়, যুবলীগের একাধিক নেতা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তাদের দ্বিতীয় আবাস গড়তে বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনেছে। কেউ কেউ কম্পানিও খুলেছে এমন তথ্যও জানা গেছে।
0 facebook: