স্বদেশবার্তাঃ বর্তমান সময়ে ভারতের রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়ও হয়ে গেছে এই ধর্ষণ। শিশু,
কিশোরী, নারী কেউই বাদ যাচ্ছে না এই ধর্ষণের হাত থেকে। এমন অবস্থায় প্রায় দেড় দশক আগের
স্মৃতি মনে করছে ভারতের অগ্রগামী শহর নাগপুর। যেখানে আদালত কক্ষে প্রায় ২০০ জন নির্যাতিতার
হাতে খুন হয়েছিল এক ধর্ষক। সেই ঘটনা আবারো সামনে এনেছে দেশটির গণমাধ্যম।
সমগ্র
বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট। নাগপুর জেলা আদালতের
মার্বেল বসানো আদালত কক্ষের মেঝেতেই ফেলে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ধর্ষক আক্কু যাদবকে।
শুধু তাই নয়, কেটে নেওয়া হয়েছিল ধর্ষকের পুরুষাঙ্গটিও।
ভারতীয়
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নাগপুরের কোস্তুরবা নগরের বেশ প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে
ছিল আক্কু যাদব। যার বিরুদ্ধে একটা বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় সকল নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ
ছিল। প্রায় এক দশক ধরে ওই এলাকার বিভিন্ন নারীকে নিয়মিত ধর্ষণ করেছিল সে। দাপুটে এবং
প্রভাবশালী হওয়ার কারণে আইনের শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেয়ে যেতো ধর্ষক আক্কু। কিন্তু,
একসময় তার কাছে নির্যাতনে শিকার হওয়া নারীরাই তাকে শিক্ষা দিয়েছিলো আদালতের মধ্যেই।
কোস্তুরবা
নগর এলাকায় যেখানে আক্কু যাদব থাকতো তার পাশেই ছিল বড় বস্তি। সেই সকল দরিদ্র পরিবারের
নারীরাই ছিল আক্কুর অশ্লীল কাজের টার্গেট। বস্তির নারীদের ধর্ষণ স্বভাবে পরিণত করে
ফেলেছিল সে। প্রতি ক্ষেত্রেই পুলিশের কাছে দায়ের হত অভিযোগ। নিয়ম মাফিক গ্রেপ্তারও
হতো কিন্তু, খুব সহজেই মিলে যেতো জামিন। কারণ, সেভাবেই তৈরি হতো পুলিশের চার্জশিট।
নিয়মিত মাসোহারা এবং মদের বোতল উপহার দিত আক্কু।
ধর্ষণের
শিকার ২২ বছরের এক নারী পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালে তাকে আক্কুর প্রেমিকা দেখিয়ে চার্জশিট
পেশ করে পুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতিতাদের যৌন কর্মী দেখিয়ে আক্কুর জামিনের পথ
সুগম করে দিত আইনের রক্ষকেরা। শুধু একা আক্কু নয়, তার সাঙ্গপাঙ্গরাও এই কাজে সামিল
ছিল। অনেক সময় বস্তির মেয়েদের কোস্তুরবা নগরের অদূরে পরিত্যক্ত বহুতলে নিয়ে গিয়ে মেয়েদের
উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। মেয়েদের বয়স ১২ পার হলেই সে আক্কু বাহিনীর লক্ষ্য
বস্তু হয়ে যেতো।
এভাবেই
চলছিল আক্কুর জীবন। আর এতেই তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিল কোস্তুরবা নগরের আম জনতা। প্রায়
৩০০ পরিবারের কাছে আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিকি শতক বয়সের যুবক আক্কু যাদব। যার কাছে ধর্ষণ
প্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ক্ষোভের
আগুনে ঘি পরে ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে। কোস্তুরবা নগরের বাসিন্দা নারীরা একজোট হয়ে রুখে
দাঁড়ায় আক্কুর বিরুদ্ধে। সকলকে একত্রিত করার পিছনে ছিলেন ২৫ বছর বয়সী সমাজকর্মী উষা
নারায়ণে। প্রায় ৫০০ নারী একসঙ্গে হামলা চালায় আক্কুর বাড়িতে। দিনটা ছিল ২০০৪ সালের
৬ আগস্ট। ওই দিন বিকেলের দিকে তারা সমবেত হয়ে আক্কুর বাড়িতে যায়। কিন্তু বাড়িতে ছিল
না আক্কু। বিপদ বুঝে আগেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে সে।
স্থানীয়
সূত্রে জানা যায়, পুলিশের পরামর্শেই আত্মসমর্পণ করেছিল ধর্ষক আক্কু যাদব। কারণ, বাড়িতে
বা অন্যত্র থাকলে কোস্তুরবা নগরের নারীদের হাতেই তার প্রাণ যেত। এর চেয়ে পুলিশের হেফাজত
অনেক নিরাপদ ছিল।
১৩
আগস্ট ছিল নাগপুর জেলা আদালতে ছিল আক্কুর পরবর্তী শুনানি। সেদিন আদালতে হাজির ছিল প্রায়
২০০ জন নারী। তারা প্রত্যেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সবজি কাটার ছুরি আর শুকনো লঙ্কার
গুড়ো। নারীদের পরিকল্পনা ছিল, যেভাবেই হোক নিজের বাড়িতে আর ফিরতে দেওয়া যাবে না ধর্ষক
আক্কু যাদবকে। প্রয়োজনে জেলে যেতেও তারা প্রস্তুত ছিল। যদিও এই বিষয়টিকে পরিকল্পিত
খুন বলে মানতে নারাজ সমাজকর্মী উষা নারায়ণে। তাঁর মতে, ‘সম্মিলিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল
নাগপুর আদালতে।’
শুনানির
জন্য আদালতে প্রবেশের সময়েও একবিন্দু অহংকার কমেনি আক্কুর। পুলিশের কারসাজিতে জামিন
পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিল ৩২ বছরের আক্কু। আদালতে ঢোকার মুখে নির্যাতনের শিকার এক নারীকে
উদ্দেশ্য করে গালি দেয় এবং তাকে দেখা নেওয়ার হুমকি দেয়। আদালতের মধ্যে এক ধর্ষক নারীকে
হুমকি দিচ্ছে দেখেও কিছু করেনি পুলিশ, উলটো হাসছিল।
তখনই
ওই নারী চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমরা দু’জনে একসঙ্গে পৃথিবীতে থাকতে পারব না। হয় তুই
থাকবি না হয় আমি থাকব।’ বলেই জুতো খুলে আক্ককুকে মারতে শুরু করে ওই নারী।
জমে
থাকা ক্ষোভের বারুদে সেটিই ছিল প্রথম অগ্নি সংযোগ। এরপরেই চারপাশ থেকে আক্কুর উপরে
ঝাঁপিয়ে পরে সকল নারীরা। প্রায় ২০০ জন নারীকে সামাল দেওয়ার মতো পুলিশ আদালতে ছিল না।
মাত্র ১৫ মিনিট সময়ের মধ্যেই সব শেষ। ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপান হয় আক্কু যাদবকে। এরপরে
কাটা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঝালের গুড়ো। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুসারে, আক্কুর শরীরে
৭০টি আঘাতের চিহ্ন ছিল। আরও বড় বিষয় হচ্ছে, হামলাকারী নারীরা কেটে নিয়েছিল আক্কুর পুরুষাঙ্গ।
ওই
সময় আদালত চত্বরে উপস্থিত সকল নারীই আক্কুর খুনে নিজেদেরকে অভিযুক্ত বলে দাবি করেছিল।
তাঁদের সকলকেই গ্রেপ্তার করার দাবিও উঠেছিল। প্রাথমিক অবস্থায় পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার
করা হলেও বিক্ষোভের কারণে তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। আক্কু যাদব খুনের সব দায়
নিজের মাথায় নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন সমাজকর্মী উষা নারায়ণে।
২০১২
সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় জড়িত মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। যাদের
মধ্যে ছয় জন নারী ছিল। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।
নাগপুরের
এই ঘটনার চর্চা হয়েছিল সমগ্র বিশ্বজুড়ে। ভারতের মত দেশে নারীদের এই কীর্তি স্থান পেয়েছিল
আন্তর্জাতিক স্তরের সকল সংবাদ মাধ্যমে।
খবর বিভাগঃ
অপরাধ
আন্তর্জাতিক
ধর্ষণ
0 facebook: