আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ভারতে গত তিন-চার বছর ধরে গোরক্ষার নামে যে সব মানুষ পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে, তার অনেকগুলোতেই হামলার শিকার ছিলেন হরিয়ানার মেওয়াট জেলার মিও মুসলিমরা।
গত বছর পহেলু খান, জুনেইদ কিংবা কিছুদিন আগে রাকবর খানের মতো যারা এই ধরনের ‘মব লিঞ্চিং’ বা গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন - তারা সকলেই এই এলাকার বা আশেপাশেরই বাসিন্দা।
মেওয়াটের এই মিও মুসলিমরা বংশানুক্রমিকভাবে গবাদি পশু পালন আর চাষবাস করেই দিন গুজরান করে এসেছেন। কিন্তু এখন গরু-পাচারকারীর তকমা দিয়ে যেভাবে তাদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে তাতে ভয়ে তারা বাড়িতে গরু-মহিষ রাখাই বন্ধ করে দিচ্ছেন।
শত শত বছর ধরে হিন্দুদের পাশে থেকেছে এই মিও-রা।
কিন্তু আজ ভারতের এই ‘মিনি লিঞ্চিস্তানে’ কীভাবে তাদের জীবন-জীবিকা ও বন্ধু পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে, সরেজমিনে সেটাই দেখতে গিয়েছিলাম রাজস্থান-হরিয়ানা সীমান্তঘেঁষা ওই এলাকায়।
‘বাপুজি যব ঘসেরা আয়োঁ, হিন্দু-মুসলিম ইয়ানে সব সামে যায়োঁ’ ...
মেওয়াটের গ্রামেগঞ্জে লোকশিল্পীদের গলায় আজও শোনা যায় এই গান।
আসলে সাতচল্লিশে ভারতভাগের সময় গান্ধী মেওয়াটের ঘসেরা গ্রামে এসে কীভাবে ওই অঞ্চলের মুসলিমদের পাকিস্তান যাওয়া ঠেকিয়েছিলেন, তা মিওদের লোকগাথার অংশ।
সেই কাহিনী নিয়েই ওই অঞ্চলের মিরাসি শিল্পীরা এই গান বেঁধেছেন।
কিন্তু ভারতেই থেকে যাওয়ার সেই সিদ্ধান্ত আদৌ ঠিক ছিল কি না, আজ তাদের নতুন করে সে কথা ভাবতে হচ্ছে।
হাথিন গ্রামে জামা মসজিদের সামনে জটলায় কান পাতলেই এখন শোনা যায়, বিজেপি সরকার যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছে তখন থেকেই এই দশা - তারা মুখে বলে এক, আর করে এক।
আশ মুহাম্মদ, চাঁদ খানরা বলছিলেন, ‘এই তল্লাটে কেউ কোনোদিন জাতধর্ম নিয়ে ভাবেনি, অথচ এখন সর্বত্র ভয় আর আতঙ্ক, গরু-মোষ আনতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা না-যায়!’
মিওরা হলেন আসলে পশুপালকের জাত।
হরিয়ানার মেওয়াট, আর রাজস্থানের ভরতপুর ও আলোয়াড়কে তিনটি বিন্দু ধরে একটা ত্রিভুজ টানলে যে এলাকাটা আসবে, মূলত সেখানেই তাদের বসবাস।
কেউ বলেন তারা ইরান থেকে এসেছেন, কেউ বলেন রাজস্থানের মিনা উপজাতিরাই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে মিও হয়েছেন।
মেওয়াট লাগোয়া নূহ জেলা সদরে হাজী সাহাবুদ্দিন আবার শোনালেন অন্য গল্প।
তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে খুব মিল ইয়েমেনের।’
‘ইয়েমেনের ধরনেই আমরা পাগড়ি আর জুতো পরি, হাতে লাঠি রাখি। এমন কী আমাদের মেয়েদেরও বিদায় দিই ইয়েমেনের মতোই হাতে খেজুর ধরিয়ে।’
‘আমাদের চিরকালই হিন্দুদের সঙ্গে খুব ভাব - মিওদের রাজা হাসান খান মেওয়াতি রাজপুত রানা সাঙ্গার সাথে মিলে বাবরের বিরুদ্ধে পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলেন। মিওরা কোনোদিন মুঘল শাসন পর্যন্ত মানতে পারেনি, তারা ছিল চিরবিদ্রোহী।’
গরু-মহিষ যেহেতু তাদের আয়ের প্রধান উৎস, তাই হিন্দুদের মতোই অনেক মিও গরুর গোশত ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন না।
কিন্তু যে মহিষের দুধ দুইয়ে বা মহিষকে দিয়ে হাল টানিয়ে তাদের পেট চলে - আশেপাশের গোরক্ষা বাহিনী সেগুলো বাঁচানোর নামেই ইদানীং রাস্তাঘাটে মিওদের মারধর শুরু করেছে।
মিসাল নামে যে এনজিওটি এই অঞ্চলে প্রচুর কাজকর্ম করছে, তার কর্মকর্তা খাদিজা খাদের বলছিলেন, ‘এই লিঞ্চিং শুধু তাদের জীবনের জন্য নয় - জীবিকার জন্যও হুমকি।’
‘কারণ শত শত বছর ধরে গরু-মহিষ পালন করেই এই মানুষগুলোর দিন কেটেছে - কিন্তু আজ সেগুলোই তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, কিংবা সারাক্ষণ তাদের তটস্থ হয়ে থাকতে হচ্ছে।’
‘অনেকে তো বাপ-দাদার পেশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।’
‘তাদের বহুদিনের প্রতিবেশীরাই আজ গোরক্ষার নামে পুলিশের কাছে খবর দিচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে মিলে মুসলিমদের ওপর জুলুম করছে।’
ঠিক দেড় বছর আগে রোজার মাসের আগে রাজস্থান থেকে দুধেল গাই নিয়ে আসার সময় এই জুলুমের নির্মম শিকার হয়েছিলেন নূহ-র জয়সিংপুর গ্রামের পহেলু খান।
হাইরোডে তাদের গরু-বোঝাই গাড়ি আটকে পহেলুকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।
পহেলুর ছেলে ইরশাদ তাদের বাড়ির দাওয়ায় বসে বলেছিলেন, ‘আমরা কিন্তু গরু পাচার করছিলাম না। গাই দুটো সদ্য বিইয়েছিল, দুটোর পেটেই দশ-বারো লিটার করে দুধ ছিল।’
‘জয়পুরের সরকারি মেলা থেকে এক-একটা পঁয়তাল্লিশ হাজার রুপিতে কিনেছিলাম, ওগুলো কি আমরা কসাইখানায় ছহাজারে বেচতে যাব না কি?’
‘সেই গরু কেনার রশিদ পর্যন্ত ছিল, কিন্তু কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। ওদের একটাই কথা ছিল, এরা মুসলমান - মোল্লাগুলোকে মারো!’ পহেলু খানের বিধবা স্ত্রী জেবুনার শোক জমে জমে এখন পাথর।
খানিকটা নিস্পৃহ ভঙ্গীতেই তিনি বলেন, ‘মোদীই তো সব কিছু করাচ্ছেন। তো উনি চাপ না-দিলে আমরা বিচার পাব কোত্থেকে?’
‘জানেন, আমার স্বামী চলে যাওয়ার পর দেড় বছর হয়ে গেল - এত হইচই, এত খবরের কাগজের লোক - থানার একটা চৌকিদার পর্যন্ত কখনো আমাদের বাড়িতে খোঁজ নিতে আসেনি।’
জয়সিংপুরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে।
নূহ শহরের বড় চৌরাস্তার কাছেই মেওয়াটের মিরাসি লোকশিল্পীরা ততক্ষণে গান ধরেছেন ‘গোরক্ষা কে নাম পে দেখো, ভারত কা বদনাম কিয়া ...’
তাদের গানেও এখন সেই একই আক্ষেপ, গরু বাঁচানোর নামে দেশের এত বড় বদনাম হয়ে যাচ্ছে, কারুর কোনো ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত নেই।
যে মিও মুসলিমরা আজো রাম খান, লক্ষণ খান, শঙ্কর খানের মতো হিন্দুঘেঁষা নাম নিয়ে চলেন, তারা যেন আসলে কিছুতেই ঠাহর করতে পারছেন না এত দিনের পড়শি আর বন্ধুরা কীভাবে হঠাৎ তাদের ঘাতক হয়ে উঠল?
বিবিসি বাংলা, দিল্লি
খবর বিভাগঃ
আন্তর্জাতিক
0 facebook: