বিগত ৯ মাসে প্রায় ১৪ হাজার প্রবাসী কর্মী সউদী থেকে খালি হাতে দেশে ফিরেছেন। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আয়ের দেশ সউদী আরবের প্রবাসী কর্মীরা গত জানুয়ারী থেকে জুলাই পর্যন্ত ১শ’ ৬৩ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এ শ্রমবাজারকে ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টরা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
দীর্ঘ দিন সউদী আরবে অঘোষিতভাবে জনশক্তি রফতানি বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে ২০১৫ সনে সউদীর শ্রমবাজারের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। দেশটিতে মুছানেদ সিষ্টেমে প্রথমে দুইজন মহিলা গৃহকর্মীর সাথে একজন পুরুষ কর্মী যাওয়ার সুযোগ পায়। এর আগে হাতে গোনা কিছু কর্মী যেতো দেশটিতে। বর্তমানে মুছানেদ প্রক্রিয়ায় মহিলা কর্মীর কোটা না থাকায় প্রচুর পুরুষ ভিসা থাকার পরেও এসব কর্মীদের সউদী আরবে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সীর মালিক এতথ্য জানিয়েছেন।
সউদীর শ্রমবাজার প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি গতকাল মঙ্গলবার তার দপ্তরে ইনকিলাবকে বলেন, ভ্রাতৃ-প্রতীম সউদী আরবের সাথে বাংলাদেশের অত্যন্ত চমৎকার সর্ম্পক বিদ্যমান। সউদী বাদশা’র আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সউদী আরবে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, সউদী আরবে কর্মরত বিশ লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে দেশটি’র অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কিছু কিছু প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত আসা সর্ম্পকে প্রবাসীমন্ত্রী বলেন, এটা সউদী সরকারের নিয়মিত একটা প্রক্রিয়া। এ ব্যাপারে সউদীতে কর্মরত প্রবাসী কর্মীদের আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। সউদী’র ১২ টি পেশায় প্রবাসীদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় বাংলাদেশী কর্মীদের কোনো বিরুপ প্রভাব পড়বে না বলেও প্রবাসীমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সউদীর পুরুষ কর্মীর ভিসার দাম সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমে এসেছে। ইতিপূর্বে সউদী’র একটি ভিসার দাম ৮ লাখ টাকা থেকে ৯ লাখ টাকায় বিক্রি হতো। সউদীর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় এখন সেই ভিসার দাম দুই লাখ টাকায় নেমে এসেছে। সউদীতে প্রবাসী কর্মীদের ইকামার ফি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশী কর্মীরা বিপাকে পড়েছেন। ইকামা ফি’র অর্থ যোগাতে না পেরে অনেক বাংলাদেশী কর্মী একাধিক মালিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। নির্ধারিত মালিকের অধীনে কাজ না করে অন্যত্র কাজ করায় বহু বাংলাদেশী কর্মীকে আটক করে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে সউদী পুলিশ। সউদী আরবে ১২টি পেশায় নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় অনেক প্রবাসী কর্মী চাকুরি হারিয়ে ও ব্যবসা গুটিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে শুরু করেছে। সউদী আরবে প্রবাসীদের জন্য নিষিদ্ধ কর্মক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, ঘড়ির দোকান, চশমার দোকান, ওষুধ সরঞ্জামের দোকান,বৈদ্যুতিক ও ইলেক্ট্রনিক্স দোকান, প্রাইভেটকারের খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান, ভবন নির্মাণের উপাদান, কার্পেটের দোকান, অটোমোবাইলের দোকান, ফার্নিচারের দোকান, প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাকের দোকান, শিশু ও পুরুষদের পোশাকের দোকান, চকলেট ও মিষ্টির দোকান। বর্তমানে সউদী পুলিশ যে কোন অভিবাসীকে উল্লেখিত পেশায় নিয়োজিত পাওয়া মাত্র তাদের অবৈধ বিবেচনা করে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বিএমইটি’র সূত্র জানায়, গত জানুয়ারী থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সউদী আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাকুরি হারিয়ে দেশে ফিরেছে ৪২ হাজার ১১৩ জন কর্মী। এর মধ্যে জানুয়ারী থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত শুধু সউদী আরব থেকে চাকুরি হারিয়ে এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফিরেছে ১৩ হাজার ৯৭৪ জন কর্মী। বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান,সউদী আরব থেকে প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দেশটির সরকার কিছু পেশায় অভিবাসী কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় অনেক বাংলাদেশী কর্মী চাকুরি হারাচ্ছে। তিনি বলেন, সউদী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে গিয়ে কি কারণে কর্মীরা দেশে ফিরছে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকে তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে সউদী সরকারের সাথে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে প্রবাসী কর্মীদের হয়রানি বন্ধ এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। বায়রার মহাসচিব বলেন, যাদের কাগজপত্র সঠিক থাকার পরেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফেরত আসতে হয়েছে তাদের পুনর্বাসনে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। সউদীতে কর্মী নিয়োগের চাহিদা হ্রাস পাওয়া প্রসঙ্গে বায়রা মহাসচিব নোমান শুধু সউদীর দিকে তাকিয়ে না থেকে নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে,প্রত্যাগত একাধিক পুরুষ কর্মী বলেছেন, সউদী পুলিশ রাস্তা-ঘাট ও বাসা-বাড়ী থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের ধরে সফর জেলে আটক রাখছে। সেখান থেকে কিছু দিন পর এসব প্রবাসী কর্মীদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে সউদী আরবের বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাংলাদেশীদের মাঝে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। রিয়াদস্থ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সউদীর সফর জেলে আটককৃত প্রবাসী কর্মীদের এক দিনও দেখতে যায়নি বলে প্রত্যাগত কর্মীরা অভিযোগ করেন।
হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নিযুক্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ ডেস্কের উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, সউদী থেকে প্রবাসী কর্মীদের দেশে ফেরত আসার সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, অনেক প্রবাসী কর্মীর কাগজপত্র সঠিক থাকার পরেও তাদেরকে ধরে সউদী পুলিশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আবার কারো কারো ইকামা ঠিক নেই। কি কারণে সউদী পুলিশ বাংলাদেশী কর্মীদের ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে তার সঠিক তথ্যাদি রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রাতে সউদীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ-এর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, গত ১ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ৬শ’ ৪৫ জন পুরুষ কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে সউদী আরব থেকে ৪শ’ ৮ জন, লিবিয়া থেকে ২শ’ ২৪ জন, সিরিয়া থেকে ৯ জন এবং ইরাক থেকে ৪ জন দেশে ফিরেছে। সউদী আরব থেকে কিছু কিছু মহিলা গৃহকর্মীও নানা সমস্যার কারণে দেশে ফিরছে। রিয়াদস্থ সেইফ হোমেও বেশ কিছু মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস সেইফ হোমে আশ্রিত মহিলা গৃহকর্মীদের দেখভাল করতে আর্থিক ব্যয় ভার বহন করছে।
বিএমইটি’র সূত্র মতে, ২০১৭ সনে সউদী আরবে ৫ লাখ ৫১ হাজার ২৫৩ জন মহিলা গৃহকর্মী ও পুরুষ কর্মী কর্মসংস্থান লাভ করেছে। গত জানুয়ারী থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৯৬০ জন মহিলা গৃহকর্মী ও পুরুষ কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। রিক্রুটিং এজেন্সী এভিয়েট ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সাবেক নেতা মোঃ নুরুল আমিন বলেছেন, সউদী মুছানেদ-এ শর্তের কারণে বর্তমানে রিক্রুটিং এজেন্সীগুলো পুরুষ কর্মীর ভিসা থাকার পরেও কোটার স্বল্পতার দরুন কর্মী পাঠাতে পারছে না। তিনি সউদী আরবে অবাধে মহিলা ও পুরুষ কর্মী পাঠানোর সুবিধার্থে মুছানেদ সিষ্টেমের শর্তাবলী রহিতকরণসহ দেশটিতে প্রবাসী কর্মীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজ বুধবার রিয়াদে সউদী বাদশা’র সাথে অনুষ্ঠিতব্য দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ জানান।
সম্প্রতি সউদী ফেরত বগুড়ার আবু ইউসুফ বলেন, বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও সউদী পুলিশ রাস্তা থেকে ধরে ধরে বাংলাদেশীদের জেলে দিচ্ছে। ফরিদপুরের প্রত্যাগত মেরাজের স্ত্রী মাকসুদা বলেন, সউদী কফিল মেরাজের ইকামা তৈরি করে দেয়নি। তিনি বলেন, রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস জেলে আটককৃত কর্মীদের আইনী সহায়তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। টাংগাইল জেলার নন্দিপাড়া গ্রামের জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী রোমেসা খাতুন বলেন, ৬ লাখ টাকা দিয়ে ১৩ মাস আগে সউদী গিয়েছিল জাহিদুল। সউদী কফিল জাহিদুলকে ৭ মাসের বেতন দেয়নি এবং ইকামাও তৈরি করে দেয়নি। বাসার সামনে থেকে সউদী পুলিশ তাকে ধরে সফর জেলে নিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ভিটেমাটি বিক্রি করে সউদী আরবে পাঠিয়ে আজ আমরা রাস্তার ফকির।
অ্যাকটিভ ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেস-এর স্বত্বাধিকারী ও বায়রার নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, ফ্রি ভিসার নামে সউদীতে গিয়ে অনেক কর্মী নিজস্ব কফিলের বাইরে গিয়ে কাজ করায় পুলিশ তাদের ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তিনি সউদী সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সউদী বাদশার সাথে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমবাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
খবর বিভাগঃ
জাতীয়
0 facebook: