![]() |
স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ আগামী ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের দিনও বিরোধীদের মাঠে দাঁড়াতে দেবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। নির্বাচন এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের দমনে নেয়া সরকারের সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশব্যাপী তৎপর রয়েছে মাঠপ্রশাসন। তারই অংশ হিসেবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠেনামা বিরোধী নেতাকর্মীদের পুরনো মামলায় গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। সাথে যোগ করা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। নির্বাচনে নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের হেভিওয়েট প্রার্থীদের ওপর হামলা ও গুলির ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন শুধু যে নীরব তা নয় উল্টো কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ঘটনায় বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী এবং বিজিবি মাঠে নামার পরও চলমান এসব ঘটনায় বিরোধীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদেরও ব্যাপকভাবে মাঠে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। বিরোধীদের প্রশাসনিকভাবে দমনের পাশাপাশি প্রার্থীদের পক্ষে দলীয় প্রচার নিয়ে ইতোমধ্যেই মাঠে বেশ তৎপর রয়েছেন তারা। বিশেষ করে নির্বাচনের দিন প্রত্যেক পাড়া-মহল্লা এবং ভোটকেন্দ্রে পাহারায় নিয়োজিত থাকবেন সরকার সমর্থকেরা। চিহ্নিত ধানের শীষের কর্মী বা সমর্থকেরা কোনোভাবেই যাতে ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত যেতে না পারে সে ব্যাপারে যা যা করার সবই করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনী মাঠে থাকায় গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মডেল সামনে নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। সে অনুযায়ী নির্বাচনের আগের রাত পর্যন্ত তৎপর থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের সম্ভাব্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক শক্তি কাজে লাগানো হবে। বিশেষ করে ৩০ ডিসেম্বরের আগেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি জেলা ও স্থানীয় নেতাদেরও বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হতে পারে। তবে গ্রেফতার অভিযান যাতে চোখে পড়ার মতো না হয় এবং ফলাও করে প্রচারের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে প্রশাসন। এভাবেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
আর নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলে আরো হার্ডলাইনে যাবে প্রশাসন। ওই সময় দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব কিছুই করবে সরকার। বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলে কোনোভাবেই তাদের নির্বাচনে ফেরানোর চেষ্টা করবে না সরকার; বরং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের আন্দোলন বা নাশকতা শুরু হলে কঠোরতার মাত্রাও বাড়বে। ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করে সেই সব নির্দেশনা দিয়েছেন।
তবে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন মডেলের সফলতা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। তাদের কারো মতে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রশাসনের সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে সেই শক্তি সারা দেশে ভাগ হয়ে যাবে। দেখা গেছে, সিটি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য মোতায়েন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে সেই সুযোগ থাকছে না। এ ক্ষেত্রে বিরোধী জোটের কর্মীরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে সক্রিয় থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সে জন্য খুলনা ও গাজীপুর মডেল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের সূত্রগুলো আরো জানায়, নির্বাচন ঘিরে প্রশাসনের তৎপরতার পাশাপাশি দলীয় নির্বাচনের দিন প্রার্থীর পক্ষে মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচনে মূল ভূমিকা পালন করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দলীয় নেতাকর্মীরা কেবল সহযোগী হিসেবেই মাঠে থাকবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র আরো জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি জোটের সম্ভাব্য আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল সরকারে। এতে দেশব্যাপী সহিংসতা ও নাশকতার তথ্যও ছিল। বিশেষ করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন সরকারের সময় সরকারবিরোধীরা সহিংসতা শুরু করতে পারে বলে সরকারের কাছে নানা ধরনের তথ্য দেয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নির্বাচনকালীন সরকারের কারণে এ সময় প্রশাসনের ওপর সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণও খানিকটা ঢিলে হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল। বিষয়টি মাথায় নিয়েই তফসিলের আগে কয়েক দফা প্রশাসনিক রদবদল করা হয়। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বর্তমান মাঠ প্রশাসনকেই পছন্দ সরকারের। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি জোট ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছে। তারা ঊর্ধ্বতন ও মাঠপর্যায়ের সব মিলিয়ে ৯২ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তার একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে বিএনপি জোটের দাবি অনুযায়ী মাঠপ্রশাসনে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি রদবদল হলেও তা কোনোভাবেই মানছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সূত্রগুলো জানায়, এখন পর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনে থাকবে ধরে নিয়েই এগুচ্ছে সরকার। সে জন্য ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সারা দেশে দায়ের হওয়া জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও নাশকতার মামলাগুলোর দিকে নজর দিচ্ছে প্রশাসন। এর বাইরেও গত ১০ বছরে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোকেও চাঙ্গা করা হচ্ছে। এসব মামলায় গ্রেফতার নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লাভজনক প্রতিষ্ঠানে থাকা, ঋণখেলাপি ও বিলখেলাপির দায়ে এ পর্যন্ত ১৩টি আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। তবে বাতিল হওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের কেউ নেই। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে থেকে নির্বাচন করায় গত ২০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিএনপির আটজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ফরিদুল কবির তালুকদার শামী (জামালপুর-৪), আব্দুল মুহিত তালুকদার (বগুড়া-৩), মোসলেম উদ্দিন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪), আসাদুজ্জামান (রংপুর-১), মাহমুদ হোসেন (ময়মনসিংহ-৮), আব্দুল মজিদ (ঝিনাইদহ-২), ফজলুর রহমান (জয়পুরহাট-১) এবং আবু সাঈদ চাঁদ (রাজশাহী-৬)। ফলে এসব আসনে ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থীবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এর আগে বিএনপির এই আট প্রার্থী চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ না করা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন তাদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেছিলেন। পরে কমিশনের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে পৃথক আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের শুনানি শেষে তাদের প্রার্থিতা বাতিলের আদেশ দেন হাইকোর্ট। প্রার্থিতা বাতিলের এ ঘটনায় ক্ষমতাসীনদের হাত রয়েছে বলে বারবার অভিযোগ করেছে বিএনপি। অন্য দিকে অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে আদালত প্রার্থিতা বাতিল করছেন। এতে ক্ষমতাসীন দলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এ দিকে প্রার্থিতা বাতিল ছাড়াও অন্তত ১৬টি আসনে ধানের শীষের প্রার্থীকে গ্রেফতার করে ইতোমধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরা হলেন রাজশাহী-৬ আসনের আবু সাঈদ চাঁদ, মাগুরা-১ মনোয়ার হোসেন, টাঙ্গাইল-২ সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, গাজীপুর-৫ ফজলুল হক মিলন, নরসিংদী-১ খায়রুল কবির খোকন, গোপালগঞ্জ-৩ এস এম জিলানী, কুমিল্লা-১০ মনিরুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৯ ডা: শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম-১৫ শামসুল ইসলাম, কক্সবাজার-২ হামিদুর রহমান আযাদ, সাতক্ষীরা-২ আবদুল খালেক, খুলনা-৬ আবুল কালাম আজাদ, ঠাকুরগাঁও-২ আবদুল হাকিম, সাতক্ষীরা-৪ গাজী নজরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া-১ রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা এবং যশোর-২ আসনে মুহাদ্দিস আবু সাঈদ।
প্রতিপক্ষ ধানের শীষের এসব প্রার্থী কারাগারে থাকায় একরকম ফাঁকা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নৌকার প্রার্থীরা। ধানের শীষের প্রার্থীদের পক্ষে অনেক আসনেই কাউকে প্রচারণা চালাতে দেখা যাচ্ছে না। আবার কোনো কোনো আসনে কারাবন্দী প্রার্থীদের স্ত্রী বা সন্তানদের প্রচারণা চালাতে গেলেও ক্ষমতাসীনদের হামলা ও বাধার মুখে পড়েছেন। বিজিবির পর সোমবার সেনা মোতায়েনের মধ্যেও লক্ষ্মীপুরে ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে শরীফুল আলম, শরীয়তপুরে মিয়া নূর উদ্দিন অপু, খুলনায় রকিবুল ইসলাম বকুল, শেরপুরে ডা: সানজিদা প্রিয়াংকাসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী ও তার সমর্থকদের ওপর হামলা ও গুলি চালানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ফাঁকা মাঠ তৈরি করে একতরফা বিজয়ের পথ সুগম করতে চান আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে বাগি¦তণ্ডার একপর্যায়ে বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করেন ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেনসহ সিনিয়র নেতারা।
প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) সদর দফতরে ডেকে ব্রিফ করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। নিয়মিত সভা করে নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মপন্থা ঠিক করছেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দু’জন নেতা বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি জোটের রাজনৈতিক কথাবার্তার জবাব দল থেকে সংবাদ সম্মেলন বা অন্য কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়মিতভাবে দিচ্ছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আর অন্য বিষয়গুলো দেখবে প্রশাসন। সেখানে আমাদের না জড়ানোই ভালো। সে জন্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শুধু সতর্ক থাকতে বলা হবে। এটাই আমাদের কৌশল।’
তাদের একজন বলেন, ‘সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো আওয়ামী লীগের জন্য অনুকরণীয়। এসব নির্বাচনে কোনো সহিংসতা বা নাশকতা হয়নি। ভোট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ওই নির্বাচনে কারচুপির বড় কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। সে জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচনেও সেই কৌশল নেবে সরকার। বিশেষ করে খুলনা ও গাজীপুর সিটির নির্বাচনকে মডেল হিসেবে নিয়ে এগোবেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।’
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, পুলিশ-বিজিবি ও প্রশাসনের পর বিএনপি এখন সেনাবাহিনীকেও বিতর্কিত করতে চায়। কিন্তু সেনাবাহিনী কারো পক্ষে কাজ করবে না। আর গণজাগরণ তৈরি হলে প্রশাসন কিছু করতে পারে না। আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রশাসনে ভর করে নির্বাচনে জিততে চায় না।
0 facebook: