স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আর মুনাফা যেন বিপরীতমুখী সূচক। খেলাপি ঋণ বাড়লে মুনাফা কমে যায়। আর খেলাপি ঋণ কমলে মুনাফা বেড়ে যায়। তাই ঋণ খেলাপিরা চান ঋণ পরিশোধ না করতে।
আর ব্যাংকাররা চেষ্টা করেন ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে। কিন্তু ঋণখেলাপিরা প্রভাবশালী হলে তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারেন না ব্যাংকাররা। বছরের শেষ মুহূর্তে মুনাফার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ব্যাংকাররা তাই ঋণখেলাপিদের ঋণ মন্দঋণ নানা উপায়ে ঢাকার চেষ্টা করেন। আর এটা করতে গিয়ে ব্যাংকারদের নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কখনো খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করলেও বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে খেলাপিদের ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়। কখনো ডাউন পেমেন্ট না নিয়েই ঋণ নিয়মিত দেখানো হয়। আবার কখনো কখনো ঋণের বিপরীতে দেয়া জামানতের মূল্য বাড়িয়ে তা সমন্বয় করা হয়। এমনিভাবে চলতি বছরের শেষ সময়ে মুনাফার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে নানা কৌশলে খেলাপি ঋণ কমানোর অভিযোগ উঠেছে কিছু কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, যথাযথ ডাউন পেমেন্ট ছাড়া ঋণ নবায়ন, ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও খেলাপি ঋণের উচ্চ হার কমছে না। বরং দিন দিন তা বেড়ে পাহাড় সমান হয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রথমবারের মতো অবলোপন ছাড়াই গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। মাত্র ৯ মাসে এ খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। বর্তমানে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মধ্যে মন্দঋণই ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ। মন্দঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতের মুনাফার হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।
প্রচলিত বিধান অনুযায়ী গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা করতে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষ ৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ জমা রাখতে হয়, যাকে ব্যাংকিং ভাষায় জেনারেল প্রভিশন বা সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বলা হয়। আবার যে ঋণ বিতরণ করে তা খেলাপি হয়ে গেলে ক্ষেত্রবিশেষ ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। কোনো ঋণ নি¤œমানের খেলাপি হলে তার বিপরীতে ২০ শতাংশ, আবার সন্দেহজনক খেলাপি হলে তার বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং কোনো ঋণ মন্দ বা কুঋণ হলে তার বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করে ব্যাংকগুলো তার মুনাফা দিয়ে। এ কারণে মন্দঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে যায় মুনাফা। কোনো কোনো ব্যাংক লোকসান পর্যন্ত গোনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তার ব্যাংকে প্রথমবারের মতো মন্দঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। আর এ ৭ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে বছর শেষে মুনাফার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাই নানা উপায়ে কমানো হচ্ছে মন্দঋণ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় খেলাপি ঋণের উচ্চ হার কমানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে তাই নানা উপায়ে কমানো হচ্ছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংকের বার্ষিক সমাপনী হিসাব আজ ২৭ ডিসেম্বর শেষ হবে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে তাই ঘাম ঝড়ছে পদস্থ কর্মকর্তাদের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে।
অপর এক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের একই দশা। তাই ঋণের বিপরীতে দেয়া জামানতের মূল্য বাড়িয়ে প্রভিশন সমন্বয় করা হচ্ছে। আর পুনঃতফসিল সুবিধাতো রয়েছেই। সব মিলিয়ে ডিসেম্বর শেষে মুনাফার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় খেলাপি ঋণের উচ্চ হার কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির। তিনি ওই সভায় ব্যাংকারদের খেলাপি ঋণের উচ্চ হার থেকে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
একজন এমডি গতকাল জানিয়েছেন, গভর্নর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো কোনো খেলাপি এখন ঋণ পরিশোধ করছেন না। এদের দেখে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তারাও ব্যবসা মন্দার কথা বলে ঋণ পরিশোধ করছেন না। এ কারণে ঋণ আদায় করে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না। ওই এমডি বলেন, এ পরিস্থিতিতে গভর্নরের নির্দেশের পর বুঝতেই তো পারছেন আমরা কিভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
0 facebook: