30 August 2019

আমাদের আর নির্যাতন করনা, প্রয়োজনে আমাদের গুলী করে মেরে ফেলোঃ কাশ্মীরী মুসলমান


আন্তর্জাতিক ডেস্ক।। যাতে কাঁদতে না পারি, সেকারনে মুখ মাটি দিয়ে ভরে ফেলা হয়। এভাবেই অধিকৃত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের সিদ্ধান্তের পর সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এ নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে সরেজমিন প্রতিবেদন করেছেন বিবিসির সাংবাদিক সামির হাশমি।

গ্রামবাসীরা তাকে বলেন, বাড়িতে বাড়িতে সেনা অভিযানের সময় লাঠি ও শেকল দিয়ে তাদের বেদম পেটানো এবং বৈদ্যুতিক শক নিপীড়ন করা হয়েছে।

বেশ কয়েকটি গ্রামের অধিবাসীরা বিবিসি সাংবাদিককে তাদের নির্যাতনের আঘাত দেখিয়েছেন। কিন্তু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তা জানতে চাইলে অভিযোগ বলে তারা দাবি করে সাংবাদিকের নিকট।

অবৈধ ভারতীয় হানাদার বাহিনী এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যায়িত করেছে। গত সপ্তাহ চারেক ধরে হিমালয় অঞ্চলটিতে নজিরবিহীন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যটির সাত দশকের স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেয় অবৈধ ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার। এর পর সেখানে ফোন সংযোগ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।

এ ঘোষণার আগেই সেখানে কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। যদিও আগে থেকেই সাত লাখের বেশি সেনা অবস্থান করছে পৃথিবীর ওই ভূস্বর্গে।

ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীসহ তিন হাজারের বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের অনেককে কোথায় রাখা হয়েছে, পরিবার কিংবা স্বজনদের তা জানানো হয়নি।

এসব হামলাকে নিবৃত্তিমূলক বলে দাবি করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতেই এমনটি করা হচ্ছে।

ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে গত তিন দশক ধরে কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে। রাজ্যটির স্বায়ত্তশাসন বাতিলের সিদ্ধান্তকে অধিকাংশ ভারতীয় স্বাগত জানিয়েছেন। এমনকি গণমাধ্যমও মোদি সরকারের এই উদ্যোগে উচ্ছ্বসিত সমর্থন দিয়ে এসেছে।

গেল কয়েক বছর ভারতবিরোধী বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আসা কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলার কয়েকটি গ্রামে ভ্রমণ করেছেন বিবিসির সাংবাদিক।

রাতে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালানোর সময় নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয়দের পিটিয়ে ও নির্যাতন করে আহত করেছে। তবে রোগীদের অসুস্থতা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করেছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

নিরাপত্তা বাহিনীর আঘাতে লোকজনের শরীরে সৃষ্ট হওয়া ক্ষত গ্রামবাসীরা বিবিসি সাংবাদিককে দেখিয়েছেন।

একটি গ্রামের অধিবাসীরা বলেছেন, ওই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালিয়েছে।

গ্রামটির এক সহোদর বলেন, ঘুম থেকে জাগিয়ে তাদের বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে গ্রামের আরও একডজন লোককে জড়ো করা হয়। তাদের সবাইকে আতঙ্কিত অবস্থায় দেখা গেছে।

একজন বলেন, তারা আমাদের বেদম পিটিয়েছে। সেনাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমরা কী করেছি? আমরা মিথ্যা বলছি কিনা; গ্রামের লোকজনকে তা জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। আমরা কি কোনো খারাপ কিছু করেছি? কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শুনতে চায়নি। কেবল সবাইকে ইচ্ছামতো পিটিয়েছে।

তারা আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পিটিয়েছে। লাথি মেরেছে, লাঠি দিয়ে বেদম পিটিয়েছে, বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে। শিকল দিয়ে বেধড়ক আঘাত করেছে। পা দিয়ে পেছনে লাথি মেরেছে। যখন আমরা মূর্ছা গেছি, জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, যাতে কাঁদতে না পারি, তাই মাটি দিয়ে মুখ ভরে দেয়া হয়েছে। তাদের বললাম- আমরা নিরপরাধ। তাদের নির্যাতন এতটাই অসহনীয় ছিল যে, আমাদের যেন নিয়ে যান, আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনা করছিলাম।

ভারতীয় বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে এক তরুণ বলেন, তারা আমার কাছে পাথর নিক্ষেপকারীদের নাম জানতে চায়, কিন্তু আমি বলি- এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তখন তারা আমাকে চশমা, পোশাক ও জুতা খুলতে নির্দেশ দেয়।

ওই তরুণ জানান, পোশাক খোলার পর তারা তাকে রড ও লাঠি দিয়ে একনাগাড়ে দুই ঘণ্টা নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। এর পর তিনি অচেতন হয়ে পড়লে জাগিয়ে তুলতে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে।

তারা যদি ফের আমার ওপর এভাবে নির্যাতন চালায়, আমি যে কোনো কিছু করতে পারব। দরকার হলে অস্ত্রও তুলে নিতে পারব,’ যোগ করলেন ওই তরুণ। গ্রামবাসী যাতে ভয়ে বিক্ষোভে অংশ না নেয়, সে জন্য এমন হিংস্র নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে বিবিসিকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেখানে বেসামরিক লোকজনের ওপর কোনো বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেনি। এ রকম কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আমাদের নজরে আনা হয়নি। বৈরী শক্তি সম্ভবত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব অভিযোগ করেছেন।

একটি গ্রামে ২০ বছর বয়সী এক তরুণের সঙ্গে দেখা করেন বিবিসির প্রতিবেদক। ওই তরুণ তাকে বলেন, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি তথ্যদাতা হওয়ার জন্য তাকে আটক করার হুমকি দেয় সেনাবাহিনী।

পরে সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করায় তাকে এমনভাবে মারধর করা হয়েছে যে, দুই সপ্তাহ ধরে তিনি স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেনি।

ওই তরুণ বলেন, তারা আমাকে এমনভাবে পিটিয়েছে, যেন আমরা পশু। যদি এভাবে নির্যাতন অব্যাহত থাকে, তবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না।

নিজের আঘাত দেখিয়ে আরেক কাশ্মীরি বলেন, তাকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে ১৫-১৬ সেনাসদস্য শেকল, লাঠি ও বন্দুক দিয়ে পিটিয়েছে।

তিনি বলেন, আমি অর্ধচেতন হয়ে পড়লে তারা আমার দাড়ি ধরে এমন হেঁচকা টান দিয়েছে, আমার সব দাঁত পড়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বালক বলে, এক সেনাসদস্য তার দাড়ি পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করলে আরেকজন এসে তা থামিয়ে দেয়।


শেয়ার করুন

0 facebook: