তাসলিমা শেয়ারে
লিখেছেন,
মুফতিদের এসব
ফতোয়া জারি করা এখন থেকেই বন্ধ করতে হবে। ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি দেশে আইন প্রণয়ন
অত্যন্ত জরুরি। আমি অন্য অনেক উদারপন্থীদের মতো বলছি না, ফতোয়া ইসলাম
বিরোধী। এ পর্যন্ত দেশে দেশে যত ফতোয়া দিয়েছেন মুফতিরা, তার সবই কোরান
হাদিস থেকেই নেওয়া। কোনও মুফতিই মনগড়া ফতোয়া দেননি। তবে আমাদের এ কথা মনে রাখতে
হবে, সপ্তম শতাব্দির আইন কানুন, রীতিনীতি এনে একবিংশ শতাব্দিতে জোর
করে ঢুকিয়ে দিলে সমাজ তার ভারসাম্য হারায়। সমাজের অগ্রসরতা রক্ষা করতে হলে ধর্মের
জায়গায় ধর্মকে রাখতে হবে। ধর্ম বিশ্বাসের জন্য, ধর্মের নথিপত্র
সংগ্রহশালায় রাখার জন্য, দৈনন্দিন জীবনে নামিয়ে এনে ক্যাওস সৃষ্টি করার জন্য
নয়।
বাংলা ট্রিবিউনে
যা লিখেছেন,
মুসলমানদের
মধ্যেও যে প্রগতিশীল, নারীবাদী, মানবতাবাদী,
উদার
এবং দয়ালু মানুষ আছেন, শিল্পী সাহিত্যিক আছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন
এমন মানুষ আছেন– তা অনেকের জানা
নেই। অধিকাংশ অমুসলমান মনে করে, মুসলমান মানেই কট্টরপন্থী যে অমুসলিমকে নির্যাতন করে,
ইসলামের
সমালোচকদের কুপিয়ে মারে, নারীকে
বোরখা পরায়, পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলে, আর কথায় কথায়
হাস্যকর সব ফতোয়া দেয়। ফতোয়া জারি করার বৈধ অধিকার মিশরের আল আজহার
বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একবার ফতোয়া দেওয়া হলো, পুরুষ-সহকর্মীদের
বুকের দুধ খাওয়াতে হবে মেয়েদের। তাহলেই ওরা আর পরপুরুষ নয়, তাহলেই
ওদের সঙ্গে বসে অফিস করাটা বৈধ বলে গণ্য হবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের
বিরুদ্ধেও একবার বিবি-তালাকের ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল, যেহেতু ইসলামের
কোনও একটি আইন নিয়ে শিক্ষকের প্রশ্ন করাকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। ফারাগ
ফোদা নামের এক লেখকের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্লাসফেমি করেছে বলে ফতোয়া
দিয়েছিল। ১৯৯২ সালে মুসলিম কট্টরপন্থী গোষ্ঠী ফারাগকে হত্যা করেছিল। ভারতের
দেওবন্দে যে দারুল উলুম মাদ্রাসা, একেও আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই
ফতোয়ার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতে দারুল উলুম মাদ্রাসা তাছাড়াও আরও একটি কারণে
গুরুত্ব পায়, তা হলো, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়,
ব্রিটিশকে
সমর্থন না করে গান্ধী এবং কংগ্রেস দলকে সমর্থন জানিয়েছিল দারুল উলুম। কিন্তু নিজের
মান মর্যাদা এখন নাশ হচ্ছে এর। কারণ নতুন যে সব ফতোয়া জারি করছে দারুল উলুম,
তা
নিতান্তই নারী বিদ্বেষী এবং নিশ্চিতই নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। দারুল উলুমের
ফতোয়াগুলোর নমুনা দেখাচ্ছি– নারীদের অধিকার নেই দেশের শাসক হওয়ার, চাকরি-বাকরি
করার, নারীদের অধিকার নেই বিচারক হওয়ার। অধিকার নেই টুইটার ফেসবুকে ফটো পোস্ট
করার, মোবাইল ফোন ব্যবহার করার। তারপর যখন তিন-তালাক নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, দিব্যি
তিন তালাকের পক্ষে, এমন কী হালালা বিয়ের পক্ষে রায় দিচ্ছে।
দারুল উলুম ছাড়াও
আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের ফতোয়া জারিকে বৈধ বলে মনে করে মুসলমানেরা। ইন্দোনেশিয়ার
মুফতি গোষ্ঠী উলিল আবসার আব্দাল্লাকে তাঁর এক লেখার জন্য মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া
দিয়েছিল। কুর্দি লেখক মারিয়ান হালাবযায়ির বিরুদ্ধেও মৃদ্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি হয়েছে।
নাইজেরিয়ার সাংবাদিক ইসিওমা ডানিয়েলের বিরুদ্ধেও মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া। কারণ ইসিওমা
বলেছিল, ‘মুহম্মদ বেঁচে থাকলে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আসা মেয়েদের মধ্যে থেকে
একজনকে বিয়ে করতেন’। ফতোয়া
দেওয়া হয়েছে আরও অনেকের বিরুদ্ধে। কিন্তু ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে কোনও দেশের কোনও সরকারই
কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শুনিনি। ধর্মপ্রাণ মুসলিমারাও কোনও আওয়াজ ওঠায়নি,
চুপচাপ
মেনে নিয়েছে সমস্ত ফতোয়া। শুধু যুক্তিবাদিরাই প্রতিবাদ করে। যুক্তিবাদিরাই দেশে
দেশে আজও সংখ্যালঘু।
ভারতে আমার
বিরুদ্ধে বেশ কিছু ফতোয়া জারি হয়েছে। রাজা একাডেমি, অল ইন্ডিয়া মুসলিম
ল বোর্ড, মজলিস বাচাও তেহেরেক, মজলিশে ইত্তেহাদ উল মুসলেমিন নামের প্রতিষ্ঠানগুলো
আমার মাথার মূল্য বেশ কয়েকবার ঘোষণা করেছে। সানিয়া মির্জার কাপড় চোপড় নিয়েও ফতোয়া
জারি হয়েছে।
সবচেয়ে আলোচিত
ফতোয়া সম্ভবত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খোমিনির দেওয়া সালমান রুশদির বিরুদ্ধে
মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া। সালমান রুশদি বেঁচে আছেন, কিন্তু তার
জাপানি অনুবাদককে মেরে ফেলা হয়েছে, তার নরওয়েজিয়ান প্রকাশককে গুলি করা
হয়েছে, তার ইতালিয়ান অনুবাদককে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আর তার তুর্কী অনুবাদক আজিজ
নেসিনকে হত্যা করার জন্য তুরস্কে যে হোটেলে তিনি ছিলেন, সেটি জ্বালিয়ে
দেওয়া হয়েছিল, সাইত্রিশ জন মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ফতোয়া খুব ভয়ঙ্কর।
তুমি কোনও গণতান্ত্রিক দেশে কারও বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করে
ভালোমানুষের মতো ভিড় ঠেলে বেরিয়ে যেতে পারো, কিন্তু মুর্খ
কিছু ধর্মান্ধ কোনও রকম চিন্তাভাবনা না করেই সেই ফতোয়া কার্যকর করবে, এটিকে
তার ঈমানি দায়িত্ব বলেই সে জ্ঞান করবে। সেটি তুমি ভালোই জানো। রাজনৈতিক নেতাদের
সঙ্গে তোমার ওঠাবসা আছে বলে পার পেয়ে যাও, কিন্তু ওই খুনির
চেয়েও বড় অপরাধী তুমি।
আল আজহার
বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নানা দেশের নানা মুসলিম প্রতিষ্ঠানও ফতোয়া দেয়। প্রতিষ্ঠানের
মুফতিরাই শুধু দিতে পারে ফতোয়া।
হায়দারাবাদের
জামিয়া নিজামিয়া নামের ইসলামি প্রতিষ্ঠান নতুন ফতোয়া দিয়েছে মুসলিম মেয়েরা যেন
ব্যাংকে চাকরি করে এমন ছেলেকে বিয়ে না করে। খাবার দাবার নিয়েও ফতোয়া। মুসলমানরা
যেন চিংড়ি না খায়, কারণ চিংড়ি মাছ নয়। চিংড়ি পোকামাকড়। পোকামাকড় খাওয়া
ইসলামে বারণ। হিব্রু বাইবেল থেকে, ইহুদিদের সংস্কৃতি থেকে, কুসংস্কার
থেকে, জীবন যাপনের অভ্যেস থেকে প্রচুর গল্প গাঁথা, প্রচুর রীতিনীতি
মুসলমানেরা ধার নিয়েছে। আদম হাওয়ার গল্প থেকে শুরু করে বাইবেলের অনেক গল্পই এখন
তাদের ধর্মগ্রন্থে। ইহুদিদের শুকর না খাওয়ার সংস্কারও এখন তাদের। খোলওয়ালা
সামুদ্রিক প্রাণী বা মাছ না খাওয়ার ইহুদি সংস্কারটা কিছু মুসলমান গ্রহণ করতে চাইছে।
তাই ফতোয়া জারি হয়েছে। এসব ফতোয়া আজকাল কেউ ভালো চোখে দেখে না। ফতোয়া আগে কতটুকু
গুরুত্বপূর্ণ ছিল হয়তো, এখন সভ্য শিক্ষিত মানুষেরা মনে করে, এইসব
সভ্যতাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী
ফতোয়াগুলো ইসলাম সম্পর্কেও মানুষকে খারাপ ধারণা দিচ্ছে। মুসলমানদের মান-সম্মানও
যথেষ্ট ক্ষুন্ন হচ্ছে।
ইসলাম সম্পর্কে
সব মুসলমানের জ্ঞান খুব ভালো, এ কথা কোনও মুসলমানও বলবে না। ইসলাম কী করতে বলেছে,
কী
করতে বারণ করেছে– অনেকে মুসলমানই সঠিক জানে না, তাই
ইসলাম-বিশেষজ্ঞদের কাছে তারা যায় নানা
প্রশ্ন নিয়ে। মুফতিরা উত্তর দেন, আদেশ-উপদেশ দেন। অন্ধকার যুগে মানুষ
ফতোয়া মেনে নিলেও এ যুগে একে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। মানুষ এখন গণতন্ত্রের মানে
জানে, এখন নারীবাদীদের কাছ থেকে নারীর সমানাধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনছে,
এখন
কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার জন্য চারদিক থেকে আবেদন আসে।
বৈষম্যহীন সমাজ
নির্মাণের লক্ষ্যে সৎ এবং স্বপ্নবান মানুষেরা জমায়েত হন। ফতোয়া দিন দিন দাঁত কপাটি
মেলে প্রকাশ করছে এর যুক্তিহীনতা, নারীবিদ্বেষ, এর
মূর্খতা। হাজার বছর আগের নথিপত্র খুলে
কোনও সমস্যার সমাধান করতে চাওয়া বোকামো শুধু নয়, অমানবিকও। সেই
সময়ে আরবেরা যে দৃষ্টিতে নারীদের দেখতো, এখন সে দৃষ্টিতে
দেখলে চলবে কেন? মানুষের মনে ধর্মের ব্যাপারে সংশয় জাগবে। মানুষ আজ
না হোক কাল এসব ফতোয়া অস্বীকার করবে। সমানাধিকারের ভিত্তিতে তৈরি করা সভ্য আইনের
পক্ষপাতী মানুষ, মানুষ আর মেনে নেবে না ঘৃণা, আর
মেনে নেবে না অকারণ বিদ্বেষ। নারীকে সবসময় ক্ষুদ্র তুচ্ছ করাটা একসময় ধার্মিক
পুরুষও আর পছন্দ করবে না।
মুফতিদের এসব
ফতোয়া জারি করা এখন থেকেই বন্ধ করতে হবে। ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি দেশে আইন প্রণয়ন
অত্যন্ত জরুরি। আমি অন্য অনেক উদারপন্থীদের মতো বলছি না, ফতোয়া ইসলাম
বিরোধী।
সমাজের অগ্রসরতা
রক্ষা করতে হলে ধর্মের জায়গায় ধর্মকে রাখতে হবে। ধর্ম বিশ্বাসের জন্য, ধর্মের
নথিপত্র সংগ্রহশালায় রাখার জন্য, দৈনন্দিন জীবনে নামিয়ে এনে ক্যাওস
সৃষ্টি করার জন্য নয়।
বিঃদ্রঃ এই লিখার
সাথে স্বদেশবার্তার কোন সম্পর্ক নয় কারন আমরা নিজেদের মুসলিম হিসেবে, দ্বীন কে
ইসলাম হিসেবে, রাসূল চল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নবী হিসেবে, কুরআন সুন্নাহ
আর আলেম উলামাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে মানি।
খবর বিভাগঃ
ধর্মীয় বিদ্বেষ
0 facebook: