20 April 2018

সিরিয়াকে এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিচ্ছেই রাশিয়া


আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, সিরিয়ার ওপর সাম্প্রতিক হামলার পর দেশটিকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৩০০ না দেয়ার আর কোনো কারণ নেইএস-৩০০ না দেয়ার বিষয়ে মস্কোর জন্য সব ধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা দূর করে দিয়েছে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা

ল্যাভরভ বলেন, এক দশক আগে আমাদের বন্ধুদের অনুরোধের কারণে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, সিরিয়ার সরকারকে এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেব না এবং আমরা তাদের যুক্তিকে মেনে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, এ ধরনের ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে যদিও এস-৩০০ সম্পূর্ণভাবে প্রতিরক্ষামূলকআমরা তাদের কথায় কান দিয়েছিলাম কিন্তু হামলার পর আর সেই বাধ্যবাধকতা নেই

গত ১৪ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নির্দেশ দেনশনিবার সিরিয়ার স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়

হামলার পর রাশিয়া বলছে, তারা সিরিয়াকে এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে যাতে এ ধরনের আগ্রাসনের মুখে সিরিয়া নিজেকে রক্ষা করতে পারে রুশ এই ঘোষণার পর ইসরাইলের ভেতরে আতঙ্ক দেখা দিয়েছেকাারণ ইসরাইলের সেনারা প্রায়ই সিরিয়ার ভেতরে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে থাকে

সিরিয়ায় পশ্চিমা হামলা
অনেক হাঁকডাকের পর সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তিন পশ্চিমা শক্তিপ্রধানত লোহিত সাগরের মোতায়েনকৃত যুদ্ধজাহাজ থেকে সিরিয়ার কয়েকটি স্থাপনা লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হলেও এর অর্জন শূন্যঅবশ্য হামলার মাধ্যমে পশ্চিমারা আসলে কিছু অর্জন করতে চেয়েছিল কি না সেটিই স্পষ্ট নয়তাই এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও এর সময়, হামলার ধরন, পশ্চিমাদের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দেয়ার পাশাপাশি সিরীয়দের ভাগ্য যে শিগগিরই পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই সেটিও আরো স্পষ্ট হয়েছেযুক্তরাষ্ট্র যে অজুহাত দেখিয়ে সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে তা ছিল জনগণের ওপর বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনীর রাসায়নিক হামলাযদিও গত সাত বছরে প্রায় পঞ্চাশবার রাসায়নিক হামলার প্রমাণ পাওয়া গেছে দেশটিতে
তাই এই মূহূর্তে হঠাৎ এই রাসায়নিক হামলা কেন বড় কারণ হয়ে উঠল সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেসিরিয়া নিয়ে পশ্চিমাদের আসল উদ্দেশ্য যে, ‘সমাধাননয় সেটিও মনে করা হচ্ছে

গত শনিবার ভোররাতে এক যোগে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ও হোমস শহরের একটি রাসায়নিক গবেষণা ও দুটি মজুদকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সহামলায় তিনটি দেশই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেলোহিত সাগরে মোতায়েনকৃত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ থেকে পেণাস্ত্র ছোড়া হয়এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বি-১ ল্যান্সার যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করেছেমোট ১০৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে, যার মধ্যে কমপে ৫৯টি টমাহক ও ১৯টি স্ট্যান্ডঅফ ক্ষেপণাস্ত্র ছিলযদিও রাশিয়ার সহায়তা পাওয়া সিরিয়ার এয়ার ডিফেন্স বাহিনী এর মধ্যে ৭০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করেছেবাকি যে কয়েকটি আঘাত হেনেছে তাতেও খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নিঅনেক সংবাদে বলা হয়েছে, হামলার ঘোষণা শুনেই স্থাপনাগুলো খালি করে ফেলেছিল বাশার সরকার

এই হামলার পর সিরিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মনোভাব এখন পুরোপুরি স্পষ্টঅনেকেই বলছেন, এবারের এই সীমিত পরিসরের কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল লোক দেখানোদেশটির গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি লাঘবের পরিকল্পনা থেকে তারা অনেকটাই সরে এসেছে বা বাধ্য হয়েছে বলা যায়দুই মাস ধরে দোমাসহ সমগ্র পূর্ব গৌতা এলাকায় নির্মম হামলা চালিয়েছে বাশার সরকারতাদের সাথে ছিল রাশিয়ার বিমানবাহিনী আর ইরানের পাঠানো শিয়া মিলিশিয়ারা

বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা হয়েছে দিনের পর দিনশুধু এই একটি এলাকায়ই নিহত হয়েছে প্রায় দুই হাজার নিরীহ বেসামরিক লোকসরকারি বাহিনীর পূর্ব গৌতা দখল সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরই পশ্চিমাদের কাছ থেকে হামলার ঘোষণা এসেছেঅথচ এই দুই মাসে তারা একটি বারও সিরীয় সরকারের হামলা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি

আবার যে রাসায়নিক হামলাকে যুক্তরাষ্ট্র উপলক্ষ বানিয়েছে সেটিও নতুন নয়গৃহযুদ্ধের গত সাত বছরে প্রায় পঞ্চাশবার নিষিদ্ধ রাসায়নি গ্যাস হামলা চালিয়েছে বাশারের সেনাবাহিনীপর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো বলছে, অন্তত ৩৪টি রাসায়নিক হামলার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে তাদের কাছেকয়েক হাজার লোক নিহত হয়েছে শুধু রাসায়নিক হামলায়আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনে নিষিদ্ধ এসব অস্ত্র ব্যবহারের জন্য ইতঃপূর্বে কখনোই সিরীয় সরকারকে প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র

সিরিয়ার সাধারণ নাগরিকরাও তাই হামলার উদ্দেশ্যকে দেখছেন সন্দেহের দৃষ্টিতেহামা প্রদেশের সমাজকর্মী হাজেম আল শামি আলজাজিরাকে জানিয়েছেন এ হামলার বিষয়ে সাধারণ জনগণের মনোভাবের বিষয়টিতিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে নেতিবাচকভাবে নিয়েছে সিরিয়ার বেসামরিক নাগরিকেরাআল শামি বলেন, ‘এই হামলার কোনো কার্যকারিতা নেই, সেনাঘাঁটি কিংবা যেখানে থেকে জঙ্গিবিমান উড্ডয়ন করে ব্যারেল বোমা ফেলেÑ তেমন কিছুই ধ্বংস হয়নি এতে

গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অনেক এলাকায় রাসায়নিক হামলা হয়েছে; কিন্তু একবারো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি যা বাশার সরকারকে চাপে ফেলতে পারে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব গৌতায় বাশার সরকার ও তাদের বিদেশী মিত্রদের দুই মাসের দীর্ঘ হামলার পর পশ্চিমাদের কাছ থেকে এই প্রতিক্রিয়া এলতত দিনে আরো অনেক বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকার মতো পূর্ব গৌতাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছেহতাহতের পাশাপাশি গৌতায় উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় দেড় লাখ লোকএই এলাকার উদ্বাস্তুদের একজন নুর আদম মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শনিবারের এই হামলা বাশার সরকারের ওপর কোনো প্রভাবই ফেলবে না

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় গৌতা ছেড়ে আরো অনেকের মতো উত্তর সিরিয়ায় আশ্রয় নেয়া এই ব্যক্তি বলেন, ‘আরো অনেক দিন আগেই এমন হামলা হওয়া উচিত ছিলআমরা আশা করেছিলাম, তারা সরকার ও সরকারের মিত্র ইরান-রাশিয়ার ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারবেতারা সরকারের গৌতা দখল করা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, এসবই ছিল পরিকল্পিতরাশিয়া ও বাশার সরকার যখন গৌতা দখল করে নিয়েছে, তারপর তারা হামলা চালিয়েছে

এই দুই ব্যক্তির কথায় স্পষ্ট যে, সিরীয় নাগরিকরা ধরেই নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা তাদের জন্য কোনো সুবিধা বা সৌভাগ্য বয়ে আনেনিএতদিন যেমন চলেছে বাশার সরকারের বর্বরতা তেমনটাই চলবেবাশারের সেনা ঘাঁটি, তার ক্ষেপণাস্ত্র, জঙ্গি বিমান সবই বহাল তবিয়তে রয়েছেঅথচ যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে এই খবরে আশার সঞ্চার হয়েছিল তাদের মাঝেএকই রকমভাবে গত কয়েক মাসে সিরিয়া নিয়ে সক্রিয় হয়েছে ইসরাইলতারাও দুই দফায় সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছেতবে তাদের উদ্দেশ্য শুধুই ইরানের প্রভাব রুখে দেয়াইহুদিবাদী দেশটি বরাবরই সিরিয়া ইরানি প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কায় আছে

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র সিরীয় যুদ্ধ নিয়ে সমাধানের পথে হাঁটতে আগ্রহী নয়তারাও সিরিয়াকে এখন ব্যবহার করছে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্র হিসেবেসর্বশেষ শনিবারের হামলা ছিল লোক দেখানোআলেপ্পোর সাংবাদিক ফিরাস আল আবদুল্লাহ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের যদি সত্যিই বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ইচ্ছে থাকে তবে তাকে আরো অনেক আগেই তাকে থামাতে পারত

তিনি বলেন, ‘যদি সিরিয়ার সরকারের বর্বরতার বিষয়ে তারা গুরুত্ব দিত, তারা অনেক আগেই সেটি করততাদের কাছে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পাঁচ মিনিটের কাজফিরাস আল আবদুল্লাহ বলেন, ‘তারা চায় না এই যুদ্ধ শেষ হোকএই হামলায় সিরিয়ার জনগণের কোনো উপকার হয়নি। (পশ্চিমা) দেশগুলো নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য হামলা চালিয়েছে

হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য দিয়েছেনতবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি সম্ভবত বলেছেন সিরিয়া পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও খ্যাতিমান সুইডিশ গবেষক অ্যারন লুন্ডএই গবেষক মনে করেন রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বছরের পর বছর যে কূটনৈতিক পরিশ্রম করা হয়েছে সেটি রক্ষা করতেই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা করেছে

নিউ ইয়র্কভিত্তিক সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের এই গবেষক মনে করেন, বাশার সরকারের রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার আবারো বিশ্বে রাসায়নিক যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারেআর সেটি রুখতেই যুক্তরাষ্ট্র বাশারের রাসায়নিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেতবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে সেটি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন পেনসিলভানিয়ার আর্কেডিয়া ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামির আববৌদতিনি মনে করেন এই হামলা পুরোপুরিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত

যে যাই বলুক, সব কথার সারমর্ম হচ্ছে সিরীয় জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো উদ্দেশ্য আপতত যুক্তরাষ্ট্রের নেইরাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বছরের পর বছর বিশ্বজুড়ে যে কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ হয়েছিল সেটির মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে কিংবা অব্যাহত সমালোচার মুখে নিজেদের মুখ রক্ষা করতে এই হামলা হয়েছেরাশিয়ার বিরুদ্ধে সিরিয়ার ছায়াযুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখাও এ হামলার আরেকটি উদ্দেশ্যরাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ হয়তো সফল হতেও চলেছে

আন্তর্জাতিক রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের হামলার স্থানগুলোতে ঢুকতে দিয়েছে বাশার সরকারঅর্গানাইজেশন ফর দ্য প্রোহিবিশন অব কেমিক্যাল ওয়েপন্স’ (ওপিসিডব্লিউ) যে রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের সিরিয়াতে পাঠিয়েছিল, তারা দোমা শহরে পৌঁছতে পেরেছেন গত মঙ্গলবারদলটি গত ৭ এপ্রিল রাসায়নিক হামলার মাধ্যমে ৭৮ জনকে হত্যা ও অসংখ্য বেসামরিক নাগরিককে আহত করার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করবে


শেয়ার করুন

0 facebook: