27 May 2018

মাদকের গডফাদারদের মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব


স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ যদি কেউ মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা করেন অথবা গডফাদার বা মূলহোতাহিসেবে প্রমাণিত হন, সেই ক্ষেত্রে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান রেখে বিদ্যমান আইনসংশোধনের প্রস্তাব করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসম্প্রতি প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র

সূত্র আরও জানায়, আইনি দুর্বলতার কারণে মাদকের গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদের তদন্তের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে নাএছাড়া বিদ্যমান আইনে এই অপরাধের শাস্তিও স্বল্পমেয়াদি ও জামিনযোগ্যফলে মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হলেও অনায়াসেই ছাড়া পেয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেনএতে সারাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটেছে ইয়াবাসহ মাদকের ব্যবসা

এর ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জঙ্গি দমনের মতো মাদকের সঙ্গে জড়িতদের দমন করতে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্দেশ দিয়েছেনতার নির্দেশের পর দেশব্যাপী চলছে পুলিশ ও র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযানদীর্ঘ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধেনিহতের সংখ্যাপাশাপাশি প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রেফতারের সংখ্যাওকিন্তু আইনি দুর্বলতার কারণে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দুরূহ বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদেরএমন পরিস্থিতিতে বর্তমান আইনটি সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য তাদের

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও ইন্টেলিজেন্স) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছেমাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে

১৯৯০ সালে প্রণীত হয়েছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, যা ২০০৪ সালে সংশোধন করা হয়এরপর প্রায় ১৪ বছর চলে গেছেএই সময়ের মধ্যে মাদকের তালিকায় যুক্ত হয়েছে ইয়াবাকিন্তু আইনটি রয়ে গেছে আগের মতোইতাই বর্তমান বাস্তবতায় সেই পুরনো আইনে নতুন করে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংশোধন আইন-২০১৮শিরানামে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় মাদকের খুচরা বিক্রেতা বা ডিলার ছাড়াও গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদের বিষয়টি অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়েছেমামলায় মূল অপরাধীর সহযোগী হিসেবে তাদেরও আসামি করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে

সেক্ষেত্রে তাদেরও (গডফাদার) শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসেই সঙ্গে রয়েছে অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডকেউ যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করে বা জামিনে ছাড়া পেয়ে একই অপরাধে পুনরায় দোষী সাব্যস্ত হন, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় দফায়ও তাকে আগের মতো দণ্ড ভোগ করতে হবে

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত খসরা আইনে তিনটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছেএর মধ্যে মাদকের ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকদের অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়াও গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ সংযোজন করা হয়েছেমাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যের নাম আসার পরও তাকে ধরা যাচ্ছে নাএ বিষয়টি উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্র্তা যুগান্তরকে বলেন, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে কাউকে সরাসরি ধরা যাচ্ছে না

কিন্তু মানি লন্ডারিং আইনের ধারাটি সংযোজিত হলে তার (গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষক) ব্যাংক লেনদেন বা দেশের বাইরে অর্থ পাচারের বিষয়টি তদন্তের আওতায় আনা যাবেএ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনেই সাজা কার্যকর করার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায়২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করে এ আইনে অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্তের এখতিয়ার দুদক, এনবিআর ও সিআইডির পাশাপাশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকেও দেয়া হয়সংস্থাটি এখন মাদকের ব্যবসায়ী বা গডফাদারদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের ধারাটি প্রয়োগ করতে চায় মাদক আইনের মাধ্যমে

প্রস্তাবিত খসরা আইনে বলা হয়েছে, যে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গোপনে তদন্ত করা যাবেমাদক কারবারির বিষয়ে গোপন তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোন কোন চ্যানেলে অর্থ লেনদেন করেছে, তা নিয়ে কাজ করতে পারবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরএছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাহিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে স্বীকৃতি দেয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে প্রণীত খসড়ায়

মাদকদ্যব্য নিয়ন্ত্রণ সংশোধন আইনের খসড়ায় ভয়াবহ মাদক ইয়াবার আইনগত নাম এ্যামফিটামিন’ (কোড নাম) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি নামএতে ইয়াবা ব্যবসায়ী বা অন্তরালের গডফাদারদের বিচার করতে আর কোনো বাধা থাকবে নাবিদ্যমান আইনে এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে কাউকে ৫ গ্রাম ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হলে বা তার হেফাজত থেকে ৫ গ্রাম ইয়াবা উদ্ধার হলে তাকে সর্বনিম্ন ৬ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৫ বছরের সাজা দেয়ার বিধান রাখা আছে

আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, যদি মাদকের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ১০০ গ্রাম হয়, সেক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তির সর্বনিু শাস্তি ১ বছর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর এবং এর সঙ্গে অর্থদণ্ড হবেযদি ১০০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হয় এবং ২০০ গ্রামের নিচে হয় তাহলে সর্বনিু শাস্তি ৫ বছর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর ও এর সঙ্গে অর্থদণ্ডআর মাদকের পরিমাণ যদি ২০০ গ্রামের বেশি হয় তাহলে জড়িত অপরাধীর ক্ষেত্রে সাজার বিধান মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করার প্রস্তাব করা হয়েছে

খসড়ায় শ্রেণীর মাদক হিসেবে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, আফিম ও কোকেনকে নির্দিষ্ট করে এই মাদকের সঙ্গে জড়িতদের যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির সুপারিশের পাশাপাশি আসামির জামিন অযোগ্য হবেখসরায় বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপক্ষকে যুক্তিসঙ্গত শুনানির সময় না দিয়ে অপরাধীর জামিন দেয়া যাবে নানতুন আইনে শ্রেণীর ভয়ংকর মাদক ইয়াবা২ গ্রাম পেলেও আসামির জামিন অযোগ্য হবে

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান আইনে কারা কমান্ড, কন্ট্রোল অ্যান্ড পজিশনস্পষ্ট করে মাদক ব্যবসায় জড়িতদের আমরা গ্রেফতার করতে পারিকিন্তু প্রস্তাবিত আইনে যারা অন্তরালের গডফাদার তাদেরও আমরা ধরতে পারব

তিনি জানান, মাদকের মামলা নির্দিষ্ট কোনো আদালতে বা বিশেষ আদালতে বিচারের জন্যও বলা হয়েছেএর জন্য লিখিতভাবে আইন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছেবিচ্ছিন্ন আদালতে মাদকের বিচার না করে একটি নির্দিষ্ট আদালতে যদি বিচার করা যায় তাহলে রেজাল্ট ভালো আসবে বলে জানান তিনি

ওই কর্মকর্তার কাছ থেকেই জানা গেল, ২০১৭ সালে ঢাকায় মাদকের ২ হাজার ৫৪৪টি মামলার মধ্যে ১ হাজার ১৬টি মামলার আসামির সাজা হয়পক্ষান্তরে ১ হাজার ৫২৮টি মামলার আসামি খালাস পেয়ে গেছেখালাসের হার শতকরা ৪০ ভাগ, যা ২০১৬ সালে ছিল ৪২ ভাগ এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে মাদকের মামলার আসামিদের সাজা কিংবা খালাসের তথ্য পাওয়া গেলেও পুলিশের প্রসিকিউশনের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন তথ্য মেলেনিজানতে চাইলে পুলিশের ডিসি (প্রসিকিউশন) আনিসুর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, মাদকের মামলা নিষ্পত্তির কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেইএই তথ্য পিপি অফিসে থাকতে পারেপরে ঢাকা মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবুর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, কোর্ট চলাকালীন খোঁজ নিয়ে বলা যাবে

এদিকে সারাদেশে আড়াই লাখ মাদকের মামলা বিচারাধীন আছে উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও ইন্টেলিজেন্স) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সাক্ষীর অভাবে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে নাপুলিশ সাক্ষীরা অবসরে গেলে আর সাক্ষ্য দিতে আসতে চান নাআর পাবলিক সাক্ষীরা অনেক সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে সাক্ষ্য দিতে আসেন নাএ কারণে মামলা নিষ্পত্তিসহ আসামিদের সাজার হার কমে যাচ্ছেআইনে সংশোধনী আনার পাশাপাশি আদালতে মামলা নিষ্পত্তির দিকেও নজর দেয়া উচিতকেন সাক্ষী আসছে না তার কারণ বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার আছে মন্তব্য করেন তিনি


শেয়ার করুন

0 facebook: