17 February 2018

পুলিশের পকেটে ৮ লাখ! ১২ লাখে দফারফা!


স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ আমি টাকা দিয়ে কী করবখেয়ে না খেয়ে আমার ছেলেকে ১৪ বছর ধরে লালন পালন করে বড় করেছি। সেই ছেলেকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। টাকা নয়আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই’ কথাগুলো বলছিলেন দেড় মাস আগে রাজধানীর উত্তরায় রহস্যজনকভাবে নিহত মুহম্মদ আসিবের (১৪) বাবা ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী কামাল শেখ। বুধবার যুগান্তরের কাছে এভাবেই তিনি প্রতিক্রিয়া জানান। 

তিনি বলেন ‘আমি টাকা নিতে চাইনিভয় দেখিয়ে জোর করে আমাকে চার লাখ টাকা দিয়ে পুলিশ বলে, ঢাকা ছেড়ে চলে যা; গ্রামে গিয়ে এই টাকা দিয়ে কিছু করে খেতে পারবিটাকা দেয়ার প্রমাণ রাখতে সেই ঘটনার ভিডিও করে রাখে পুলিশ

পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আসিব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ১২ লাখ টাকায় দফারফা হয়এর মধ্যে ৮ লাখ টাকা নেয় পুলিশআর বাকি চার লাখ টাকা কামাল শেখকে জোর করে দেয়া হয় এ জন্য থানায় একটি অপমৃত্যুর সাজানো মামলা করা হয়ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ এবং উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন কিশোর আসিব হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে পুরো ঘটনা তদারকি করেনঘটনার দিন রাতে আটজনকে আটক করে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশথানায় তাদের দুদিন আটকে রেখে দফারফা করা হয়

উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, তিন বন্ধু আসিব, বাবু (১৩) ও পিয়াস (১২) ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৬/এ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়ির ছাদে মাদক সেবন করে ওই সময় তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়একপর্যায়ে বাবু ও পিয়াস ধাক্কা দিয়ে আসিবকে নিচে ফেলে দেয়তারা তিনজনই উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের একটি বস্তির বাসিন্দাতবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোফাজ্জল যুগান্তরকে বলেন, সন্ধ্যার পর ওই বাড়ির ছাদে তারা খেলছিলদুটি বাঁশ একত্রে বেঁধে ওই বাড়ি থেকে পাশের নির্মাণাধীন ভবনে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে

ওই বাঁশ দিয়ে তিনজন নির্মাণাধীন ভবনে যাওয়ার সময় একজন (আসিব) নিচে পড়ে যায়২১ নম্বর বাড়ির লোকজন আসিবকে হাসপাতালে নিয়ে যানতবে আসিব মারা যাওয়ার পর ভয়ে ১০/এ নম্বর রোডের মাথায় তারা লাশ রেখে পালিয়ে যায় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে জানায়, ঘটনাটি এখনও রহস্যজনকঘটনার পর ২১ নম্বর বাড়ির মালিক জামাল উদ্দীন, তার ভাই নুরুল ইসলাম, বাবু, পিয়াসসহ আটজনকে ঘটনার দিন রাতে আটক করা হয়তাদের দুদিন আটকে রেখে ১২ লাখ টাকা আদায় করা হয়এ ঘটনার বিষয়ে বাদীর মুখ বন্ধ করতে চার লাখ টাকা দেয়া হয়

বাদীকে জোর করে টাকা দিয়ে ভিডিও করে রাখা হয়েছেঅর্থ আদায় করে পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছেএমনকি এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা বিভাগের এডিসি শাহেন শাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘জোর করে দফারফা করার কোনো তথ্য আমার জানা নেইওই ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়া হয়নিআর বাদীকে টাকা দেবে পুলিশ! পুলিশের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেইউত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি যখন ঘটে তখন তার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেনএডিসি শাহেন শাহ বিষয়টি তদারকি করেছেনপরে আমি জানতে পারি বাদীর কোনো অভিযোগ না থাকায় ওই ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে

অর্থ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে আলী হোসেন আরও বলেন, বাদী আমার কাছে কখনও আসেননিএ ধরনের কোনো বিষয় থাকলে বাদীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিনকেউ হয় তো ক্ষুব্ধ হয়ে এ ধরনের অভিযোগ করছেন ঘটনা ধামাচাপা দিতে সড়ক দুর্ঘটনার গুজব : স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ১০/এ নম্বর রোডের মাথা থেকে আসিবের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ তবে এ ঘটনা সড়ক দুর্ঘটনা বলে পুরো এলাকায় খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পারে ২১ নম্বর বাড়ির মালিক জামাল উদ্দিনের ভাই নুরুল ইসলামের ছেলে সৈকত ইসলাম ও দারোয়ান সুন্দর আলী সেখানে লাশ রেখে পালিয়ে গেছেকৌশলে তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে

এ বিষয়ে সৈকত যুগান্তরকে বলেন, রাত পৌনে ৮টায় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি একটি ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেআমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে চাচা জামাল বলেন, ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেবাড়ির দারোয়ান সুন্দর আলীকে নিয়ে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে হাসপাতাল রাখেনি এ সময় এক ভ্যানচালককে এক হাজার টাকা দিয়ে বলি ছেলেটিকে কোনো সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতেএরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসিআমি আর কিছু জানি না

আপস-মীমাংসার কথা অস্বীকার করেছেন বাড়ির মালিক জামাল উদ্দিনএমনকি পুলিশকে টাকা দেয়ার বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেননিতিনি বলেন, আমরা টাকা দেব কেন? আর আপস-মীমাংসার প্রশ্নই ওঠে না

আমরা তো আর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নইতিনটা বাচ্চা ছেলে খেলছিলঅসাবধানতার কারণে নিচে পড়ে একজন মারা গেছেপুলিশ শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাকে থানায় নিয়েছিলওই বাড়ির মালিকের এক আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আপস না করলে তাদের আদালতে চালান করে দেয়ার হুমকি দেয় পুলিশ অপমৃত্যু মামলার বিষয়ে জানেন না বাদী : আসিবের বাবা কামাল শেখ বলেন, মামলায় কি আছে তা জানি নাপুলিশ কয়েকবার আমার স্বাক্ষর নিয়েছেএখন শুনতে পাচ্ছি আমি নাকি আপস করেছি

তিনি বলেন, তার ছেলের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিলতার পায়েও আঘাতের চিহ্ন ছিলতাকে কেউ হত্যা করেছেতিনি আরও জানান, গ্রামের বাড়ি বরগুনায় ছেলের লাশ দাফন করে ফেরার পর এসআই মোফাজ্জল তাকে থানায় যেতে বলে সেখানে জোর করে পুলিশ তাকে চার লাখ টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে বলেতখন তিনি বলেন, ছেলেকে হত্যা করা হয়েছেএখন গ্রামের বাড়িতে চলে যাব এটা কেমন কথাএই বিষয়ে চুপ থাকতে বলে পুলিশ


শেয়ার করুন

0 facebook: