30 May 2018

লালবাগে ১১ পুলিশের নামে চাঁদা আদায়


স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ রাজধানীর লালবাগের বিভিন্ন স্পটে ১১ পুলিশ সদস্যের নামে সারা বছর ধরে চাঁদা উঠানো হয়একজন সহকারী কমিশনার (এসি), একজন পেট্রল ইন্সপেক্টর (পিআই), দুই পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, থানার পরিদর্শক (অপারেশন), উপকমিশনারের (ডিসি) দুই কনস্টেবল, দুই বডিগার্ড এবং দুই গাড়িচালকের নামে টাকা তোলা হয়

প্রতিদিন ফুটপাতের প্রতি দোকান থেকে পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার নামে ২০ টাকা করে ১০০ টাকা ও ডিসির ছয় স্টাফের নামে ২০ টাকা করে ১২০ টাকা চাঁদা তোলা হয়তবে ঈদকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার থেকে আইজিপির নামেও আরও ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে

নয়াবাজার, মিটফোর্ড, বাবুবাজার সেতু, আরমানিটোলা, ইসলামপুর, সদরঘাট এবং বাকল্যান্ড বাঁধসহ পুরান ঢাকার ছোটখাটো ব্যবসায়ী, ফুটপাতের হকার এবং পরিবহন মালিক কেউই চাঁদাবাজির থেকে রেহাই পাচ্ছেন না এতে কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতনসহ মিথ্যা মামলার খড়গএমনকি সাজানো অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে প্রতিবাদকারীর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়পুলিশের সোর্স মেহেদী হাসান কুদ্দুস নিজস্ব লোকজন দিয়ে এই চাঁদা তোলে

আইজিপির নামে টাকা তোলার আগে সোর্স মেহেদী তার ভাগনে সালামকে দিয়ে দোকানদারদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়এবার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বেড়েছেআইজিপির নামে অতিরিক্ত ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হবেএই খবর সবার কাছে পৌঁছার পর ইউনুস মাঝি, শাওন, সালাম বেপারি, পেটপোড়া সাইফুল, লম্বা সাইফুল, মাহাবুব, লম্বা জসিম এবং ফর্সা জসিমসহ ১৫-২০ জন চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েপুরান ঢাকার ফুটপাতসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা অতিরিক্ত চাঁদা তুলতে শুরু করেযুগান্তরের কাছে এ খবর আসার পর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পর শনিবার থেকে আইজিপির নামে চাঁদা তোলা বন্ধ হয়ে যায়তবে নিয়মিত চাঁদা তোলা বন্ধ হয়নিএছাড়া আরমানিটোলা ও নয়াবাজার এলাকার শতাধিক ট্রান্সপোর্ট থেকে এসি ও পিআইয়ের নামে সপ্তাহ ও মাসিক ভিত্তিতে টাকা তোলা হচ্ছে
এসব ট্রান্সপোর্ট থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আট হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা নেয়া হয় বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়

পুরান ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিশু মিয়া জানান, চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় পুলিশের সোর্সরা তার ওপর নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন চালায়এমনকি তাকে মিথ্যা অস্ত্র মামলায় গ্রেফতারও করায়ওই মামলায় জামিন পেতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন পুলিশের পক্ষে চাঁদাবাজি করে বলে ওদের সাত খুন মাফভুক্তভোগী সোহেল রানা, জাহিদ হাসান মিন্টু ও রুবেল গাজী জানান, প্রতিদিন চাঁদাবাজরা ফুটপাতের হকার, ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভ্যানচালক, ঠেলাওয়ালা, বাস-ট্রাক, হলার-লেগুনা স্ট্যান্ডসহ নকল ওষুধ, পলিথিন ও নকল কসমেটিকস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক ও সাপ্তাহিক চাঁদা নিয়ে থাকে

বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর নিচে অনেক দোকানপাট বসিয়েও সেখান থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সোর্সরাকোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার ও লালবাগ থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে এসব সোর্স
স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার পুলিশের বড় সোর্স মেহেদী বড় বড় ইয়াবা চালানের সঙ্গে যুক্তপুলিশের সোর্স পরিচয়ে হিমেল, মাইকেল, এরশাদ, সাগর, তুফান, আবদুর রব, আলমগীর, বিল্লাল, বাসেত, আজমল ও তৌহিদ লালবাগ এবং চকবাজারে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে

তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা না দিলে মাদক ব্যবসায়ীদের সমস্যা হয়টাকা না দিলে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়তাদের মধ্যে হিমেল, শাওন ও এরশাদ সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িততাদের নামে মাদক ও মারামারির মামলা রয়েছে স্থানীয়রা জানান, কামরাঙ্গীরচরে সোহেল, জালাল, বিল্লাল, কুট্টি, সিডি মিন্টু, আরিফ, আশরাফ, চান্দু, কার্তিক, সেকান্দার, রব, মোটা কাদের ওরফে কালা কাদির, জামাল ওরফে র‌্যাব জামাল এবং শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে

বেশির ভাগ সময়ই তারা মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছেকামরাঙ্গীরচরের মাদবর বাজার, রনি মার্কেট, হাজারীবাগের ট্যানারি মোড়, মিতালি রোড এবং লালবাগের কেল্লার মোড়ে তাদের তৎপরতা বেশিকোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এলাকায় জামান, লিটন, শম্ভু, মনোয়ারা, সেলিম, ফেনসি রমজান, ইয়াবা জিলু, কানাই, সামসু, জাহাঙ্গীর, শাকিল, সুজন, মাসুদ, সাব্বির, বাবলু, শফিক ও মুজিবর পুলিশের সোর্স পরিচয়ে অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে

পুরান ঢাকার আকমল খান রোডের বিক্রেতা সালাউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, মেহেদীর লোকজন প্রতিদিন পুলিশের নামে ৮০ টাকা করে নেয়অন্য একজন ৩০ টাকা করে নেয়বৃহস্পতিবার থেকে আইজিপির নামে ২০ টাকা করে নেয়া শুরু করে মেহেদীর লোকজনতবে শনিবার আইজিপির নামে টাকা নেয়া হয়নিএকই ধরনের তথ্য দেন, একই রোডের মনির এবং বাবুবাজার ব্রিজের সিঁড়ির ফল বিক্রেতা বাদশা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, পুলিশের লালবাগ জোনের এক পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে মেহেদীর দহরম-মহরম সম্পর্কতাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশিওই পুলিশ কর্মকর্তাকে মেহেদী যদি বলেন, ‘স্যার আপনার পরনের গেঞ্জিটা খুব সুন্দরতাহলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার পছন্দ হলে এটি নেনআর আপনারটা আমাকে দেনএ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অন্যতম প্রধান সোর্স মেহেদী বলেন, ‘এসবের সঙ্গে আমি জড়িত নইপুরান ঢাকায় মেহেদী নামে আরও অনেক লোক আছেনতাদের কেউ হয়তো এসবের সঙ্গে জড়িত

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হওয়া মেহেদী রোববার যুগান্তরকে বলেন, টেলিফোনে কিছু বলতে চাচ্ছি নাদেখা হলে সরাসরি কথা হতে পারেনিজেকে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেহেদি বলেন, যুগান্তরের কর্তৃপক্ষসহ বড় বড় পত্রিকার নামকরা সাংবাদিকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছেএদিকে বিষয়টি নিয়ে সোমবার বিকালে পুলিশের লালবাগ জোনের পদস্থ এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পর ওইদিন রাতে মেহেদী যুগান্তর কার্যালয়ে এসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন

তিনি জানান, পুরান ঢাকায় তৌহিদ নামে পুলিশের একজন বড় সোর্স আছেএক সময় আমি তার সঙ্গে কাজ করতামপরে নানা কারণে দ্বন্দ্ব তৈরিএ কারণে তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় নানা অভিযোগ দিচ্ছেনসোর্স তৌহিদের নামে বেশ কয়েকটি মামলা ও চার্জশিট আছে বলে মেহেদী হাসান কুদ্দুস জানান

জানতে চাইলে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এখানে প্রথাগত কোনো সোর্স নেইকমিউনিটি পুলিশ সদস্যরা আমাদের তথ্য দেন
মেহেদীসহ লালবাগ বিভাগের কয়েকজন সোর্সের নাম উল্লেখ করে তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি বলেন, মেহেদী একজন চিহ্নিত চাঁদাবাজতার বিরুদ্ধে মামলা আছেনতুন করে তার অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার খবর আমার কাছে ছিল নাআপনার কাছ থেকে শুনলামমেহেদী ও তার সহযোগীদের আজই গ্রেফতারের ব্যবস্থা করছি

পুলিশের লালবাগ বিভাগের এসি বদরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, মেহেদী একজন খারাপ লোকতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছেমারামারি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি মেহেদী সাংবাদিক পরিচয়ে চলাফেরা করেন

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফুটপাতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাইএকদিক দিয়ে অভিযান চালালে অন্যদিক দিয়ে হকাররা বসে যায়তবে এখানে কারও নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলার সুযোগ নেইকারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে

তিনি আরও জানান, যেসব সোর্স অপকর্মে লিপ্ত তাদের গ্রেফতার করে নিয়মিত মামলায় চালান দেয়া হচ্ছেতবে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা এসব নিয়ে ভালো বলতে পারবেন


শেয়ার করুন

0 facebook: