কোনো ব্যক্তির শ্বাসনালি না পুড়লে বাইরে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মৃত্যু ঝুঁকি কম। মাত্র পাঁচ থেকে দশ শতাংশ দগ্ধ ব্যক্তিরও যদি শ্বাসনালি পুড়ে যায়, তার মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও শ্বাসনালি দগ্ধ ব্যক্তিদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শুধু সচেতনতাই পারে মানুষকে এমন করুণ মৃত্যুর থেকে বাঁচাতে। বার্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান- শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বে আগুনে পোড়া ব্যক্তিদের মৃত্যুর প্রধান কারণ শ্বাসনালি দগ্ধ হওয়া। উন্নত বিশ্বের আমেরিকায়ও শ্বাসনালি পোড়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৯৬ শতাংশকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
যে ৪ শতাংশ বেঁচে যান তাদের প্রথম দিকেই কণ্ঠনালির পুড়ে যাওয়া অংশ অপসারণ করে কৃত্রিম নালি বসিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশে এ ব্যয়বহুল প্রযুক্তিগত চিকিৎসা দেয় সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দগ্ধদের মধ্যে শ্বাসনালি পোড়া ব্যক্তিদের বাঁচার নজির খুব একটা নেই। অগ্নি-ট্র্যাজেডিই নয়, প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্বাসনালি পোড়া ব্যক্তিরা বার্ন ইউনিটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। যাদের রক্ষা করা যাচ্ছে না।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় মারা যান রেজাউল করিম (২১)। পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে রেজাউল করিমসহ দগ্ধ ৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। এর আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দগ্ধ আরও দু’জন মারা যান।
তিনজনেরই শ্বাসনালি পোড়া ছিল। শ্বাসনালি পোড়া আরও তিনজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। বার্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিদিনই দগ্ধ রোগী আসছে। ১৫০ বেডের এ হাসপাতালে প্রায় সাড়ে ৭শ’ বার্ন রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কম কিংবা বেশি শ্বাসনালি দগ্ধ ব্যক্তিদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ভর্তি করাতে হয়। এসব রোগীর মধ্যে খুব কম সংখ্যক সুস্থ হয়ে উঠলেও হাসপাতাল থেকে ছাড় না দেয়া পর্যন্ত ঝুঁকি থেকেই যায়। শ্বাসনালি পোড়া রোগীদের মধ্যে এমনও কয়েকজন ছিলেন, হাসপাতাল থেকে ছাড় দেয়ার একদিন আগেও মারা গেছেন।
বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা যায়, সাভারের তাজরীন ফ্যাশন, পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজার অগ্নিকাণ্ড ‘ট্র্যাজেডি’সহ পেট্রলবোমায় দগ্ধ ব্যক্তিদের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হয়। তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ডে শ্বাসনালি দগ্ধ হয়ে ভর্তি হওয়া ৬ জনের মৃত্যু হয়। নিমতলী ট্র্যাজেডিতে শ্বাসনালি দগ্ধ হয়ে ভর্তি ১৬ জনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্বাসনালি দগ্ধ হয়ে ভর্তি হওয়া ৬ জনের মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ৩ জন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া পেট্রলবোমা অগ্নিসন্ত্রাসে দগ্ধ ১৩০ জনকে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হয়। যাদের মধ্যে শ্বাসনালি পোড়া ২৫ জনের মৃত্যু হয়। শ্বাসনালি পোড়া রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও বাঁচাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শ্বাসনালি পোড়া রোগীর প্রথমত শ্বাসনালির গতিপথে অতিরিক্ত রক্তরস জমা হতে থাকে। একে পালমোনারি কনজেশন বলা হয়। তারপর পালমোনারি হাইপার টেনশন, পরবর্তী সময়ে শ্বাসনালির সব গতিপথ সরু হয়ে যায়। এ গতিপথে ধীরে ধীরে ইপিথেলিয়াল স্লাফ, ইপিথেরিয়াল কাস্টস জমা হয়। এ কারণে শ্বাসনালির সিলিয়ারি মুভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
তখন শ্বাসনালির ভেতরের অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা বের হতে পারে না বিধায় জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন ফুসফুসে গিয়েও চেঞ্জ হতে পারে না। এ অবস্থায় রোগীর শ্বাসনালির চারপাশের ক্ষতিকারক জীবাণু শ্বাসনালিকে সংক্রমিত করে এবং রোগীর চিকিৎসা আরও জটিল হয়ে যায়। শরীরের সব স্বাভাবিক জৈবিক রাসায়নিক ও বিপাক প্রক্রিয়া ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ফলে লিভার, কিডনি এমনকি দেহকোষের সার্বিক কার্যকারিতা বিপন্ন হয়। এতে মৃত্যুঝুঁকি চরম পর্যায়ে চলে যায়। সবশেষে বাঁচানো সম্ভব হয়নি শ্বাসনালি পোড়া ব্যক্তিদের। বার্ন ইউনিটের এক চিকিৎসক জানান, দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা খুব সাবধানতার মধ্য দিয়ে করতে হয়। আইসিইউ, এইচডিইউ কিংবা ওয়ার্ডে নির্ধারিত দূরত্ব রেখে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, ১৫০ বেডের বার্ন ইউনিটে প্রায় সাড়ে ৭শ’ দগ্ধ রোগী ভর্তি রয়েছেন। বারান্দা, ফ্লোরসহ সিঁড়ির পাশেও দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এতে খুব সহজেই দগ্ধ রোগীদের মধ্যে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গত বছরের ২৪ অক্টোবর বিশ্বের সর্ববৃহৎ শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ইন্সটিটিউটে পূর্ণাঙ্গভাবে চিকিৎসা সেবা চালু হলে দগ্ধ রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা পাবেন। শ্বাসনালি পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় থাকবে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম।
এ বিষয়ে জাতীয় বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন জানান, পোড়া রোগীদের মধ্যে বহু রোগী চিকিৎসার মধ্য দিয়ে সুস্থ হচ্ছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শ্বাসনালি পোড়া রোগীদের বাঁচাতে পারছি না আমরা। ৫ থেকে ১০ শতাংশ পোড়া ব্যক্তিরও যদি শ্বাসনালি দগ্ধ হয়ে থাকে, সেই ব্যক্তি মৃত্যুঝুঁকিতে থাকেন। প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মানুষ সচেতন হলেই শুধু এমন ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
বার্ন ইউনিটের পরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, সচেতনতাই পারে এমন দুর্ঘটনা থেকে আমাদের বাঁচাতে। অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণের ঘটনা মানবসৃষ্ট, মানুষ সচেতন হলেই এমনটা বন্ধ হবে।
খবর বিভাগঃ
জাতীয়
0 facebook: