তুরস্ক হল একটা সেলফ কলোনাইজড জাতি। তুর্কিদের সম্পর্কে চেঙ্গিস খানের একটা বিখ্যাত মন্তব্য আছে। সে বলেছিল, 'তুর্কিরা যদি অন্য কোন জাতির সাথে বিয়ে-শাদী না করতো, তাহলে তারা কখনোই যুদ্ধে পরাজিত হত না।'
মুস্তাফা কামাল পাশা গ্রিস-ইতালি-ফ্রান্স-ব্রিটেন(প্রক্সি) ও আর্মেনিয়ার সম্মিলিত বাহিনীর সাথে লড়াই করে আনাতোলিয়াকে কলোনাইজারদের হাত থেকে মুক্ত করেছিল ঠিকই; কিন্তু শেষমেশ নিজেই তুর্কিদের উপর এমন এক রাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়েছে, যা খোদ কলোনাইজারদের পক্ষেও কোনদিন সম্ভব ছিল না।
প্রায় এক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সেলজুক-উসমানি সভ্যতাকে সে ইউরোপিয়ান আধুনিকতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে, ইউরোপিয়ান আইন চাপিয়ে দিয়েছে, জোর করে সেক্যুলারিজম কায়েম করেছে। সবচেয়ে মারাত্মক যে দুটি কাজ কামাল করেছে তা হলঃ
১) খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।
২) উসমানী তুর্কি ভাষাকে নিষিদ্ধ করেছে।
খিলাফাহকে তুলে দেয়ার মাধ্যমে সে ১৩০০ বছর স্থায়ী একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। ১৩০০ বছরের মধ্যে কেবলমাত্র একবার মোঙ্গল আক্রমণের ফলে তিন বছর মুসলিম উম্মাহর কোনো খলিফা ছিল না। এছাড়া ৯৩৬ সাল থেকে ১০৪৫ সাল পর্যন্ত ১১০ বছর এবং ১২৬১ সাল থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ২৫৬ বছর; মোট এই ৩৬৬ বছর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে খিলাফাহ ছিল অত্যন্ত দুর্বল; কিন্তু তবু তা টিকে ছিল।
উসমানি খিলাফাহ বিলুপ্ত করার মাধ্যমে কামাল পাশা মুসলিম উম্মাহকে এমন এক মারণাঘাত হানে, যা এমনকি দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ ডাকুরাও হানতে পারেনি।
উসমানি তুর্কি ভাষা নিষিদ্ধ করা ছিল এক সুদুরপ্রসারী চিন্তার বাস্তবায়নের অংশ। এর মাধ্যমে কামাল পাশা নিশ্চিত করে, তুরস্কের ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষ যেন আর কখনোই উসমানিয়দের প্রকৃত ইতিহাস ও উসমানি সভ্যতার শিকড়ের সন্ধান না পায়।
এই ভাষা সেলজুক ও উসমানি আমলব্যাপী প্রায় ৯০০ বছরের বিবর্তনে আরবি-ফারসি-তুর্কির মিশ্রণে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠেছিল; যাতে এই ৯০০ বছরের ইতিহাস-সভ্যতা-সংস্কৃতি-জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুই সংরক্ষিত ছিল। সাহিত্যিক মানের বিচারে আরবি-ফারসির প্রায় সমকক্ষ ছিল এই ভাষাটি।
উসমানি সালতানাতের প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডকুমেন্ট এই ভাষায় সংরক্ষিত ছিল।
এই ভাষাটিকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে উসমানি সভ্যতার সাথে আধুনিক তুরস্কের যোগাযোগের পথ বিচ্ছিন্ন করে দেন কামাল। ফলে ইউরোপের অনুকরণ ছাড়া আর কোনো উপায় তাদের সামনে অবশিষ্ট ছিল না।
এ কারণে কামালকে বলা হয় সেলফ কলোনাইজার। স্বেচ্ছায় নিজের জাতিকে যে কলোনাইজ করেছিল। (যদিও এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ; কিন্তু তা রাজনৈতিক-সামরিক কাঠামোর অনুকরনণেই সীমাবদ্ধ ছিল)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ১০০ বছর পরে এখন তুরস্ক এরদোয়ানের হাত ধরে তার ইসলামি উসমানি ঐতিহ্য আর কামালি সেক্যুলার মডার্নিটি; এই দুইয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এরদোয়ান ও আক পার্টি সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রথম যে মিথ চালু আছে তা হল, আক পার্টি একটি ইসলামিক দল। আদতে ব্যাপারটা তেমন নয়। আক পার্টির এজেন্ডার কোথাও ইসলাম বা ইসলামি শাসনের কথা নেই। তাদের আদর্শ বলতে তারা যেটা প্রচার করেন তা হল কনজারভেটিভ ডেমোক্রেসি।
কনজারভেটিভ ডেমোক্রেসিতে অর্থনীতি চলে পুজিবাদী লিবারেল ধারায়। পক্ষান্তরে তারা নৈতিকতার জায়গাতে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয়।
এটা সবাই জানে, এরদোয়ানের উত্থান 'মিল্লি গরুস' আর 'ভারচু পার্টি'র হাত ধরে। তাই এরদোয়ানের মানসিকতার গোঁড়া যে ইসলামি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা বলাই বাহুল্য। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনেও এর প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু তিনি কোনো ইসলামি দল করেননি; তিনি করেছেন সেক্যুলার দল।
কারণ কী??
কারণ, এটা তার রাজনৈতিক চাতুর্যের অংশ। তুর্কি রাজনৈতিক কাঠামোতে ইসলামি রাজনৈতিক দল করার কিছু ইনহিয়ারেন্ট অসুবিধা ছিল।
সেগুলো হলঃ
১) সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ তুরস্কে পার্লামেন্টের সমান্তরালে আরেকটি পার্লামেন্ট কায়েম করে রেখেছিল। এ কারণে আগে বারবার ন্যায্যভাবে ক্ষমতায় আসার পরেও কেবল তুরস্কের সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে এই অজুহাতে তুরস্কে ইসলামপন্থীদের জোর করে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়েছে। এমনকি আরবিতে আযান চালু করায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে।
২) প্রায় ৮০ বছর ধরে তুরস্কের মানুষ সেলফ কলোনাইজড। তাদের উপর যে মূল্যবোধ ও আইন কামাল পাশা চাপিয়ে দিয়েছিল, সেগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের মন-মগজে গেথে গেছে এবং তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় তারা নিজেরাই ইসলামি রাজনীতিতে আগ্রহী না। সাদাত পার্টির অবস্থা দেখলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়। তারা কোনো নির্বাচনেই ভালো করতে পারে না।
৩) সমাজের বেশিরভাগ মানুষের ইসলামের প্রতি ভালোবাসা আছে; কিন্তু জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে মেনে চলতে তারা এখনো প্রস্তুত না। এই অবস্থায় তাদের উপর যদি কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তবে ফলাফল বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
৪) গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে যদি বিপ্লবী ধারায় ইসলাম কায়েম করার চেষ্টা করা হত, তবে মিসরের রাবা'আ স্কয়ারের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হবার সম্ভাবনা তৈরি হতো। ওয়ার অন টেররের যামানায় কারও গায়ে ইসলামিস্ট ট্যাগ থাকলে তার প্রাণ মূল্যহীন বলে বিবেচিত হয় এবং তাকে মারার জন্য তথাকথিত বিশ্ববিবেকের কাছে জবাবদিহিতা করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
৫) সমাজের বেশিরভাগ মানুষের আদর্শ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা ঠিকমত খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি; যা প্রকৃতপক্ষে ইসলামি ধারার দলগুলোর জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। বরঞ্চ, যদি তাদের সুশাসনের নিশ্চয়তা দিয়ে ক্ষমতায় আসা যায়, তবে আক পার্টির পক্ষে পরবর্তী সময়ে ইসলামাইজেশানের সুযোগ তৈরি হবে।
এই সম্ভাবনাগুলোকে মাথায় নিয়ে এরদোয়ান ইসলামি দল নয়; বরং সেক্যুলার দল করেছেন। তাঁকে মানুষ এজন্য ক্ষমতায় বসায়নি যে, তিনি দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবেন। তাঁকে মানুষ ক্ষমতায় বসিয়েছে এজন্য যে, তিনি তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন। সিএইচপি, এমএইচপি সহ অন্যান্য দলগুলো বারবার তুরস্কের সংবিধান, সেক্যুলারিজম, কামাল পাশার আদর্শ ইত্যাদি অনেক কিছুর দোহাই দিয়েও এরদোয়ানের ওপর মানুষের আস্থা দূর করতে পারেনি। কেননা, এই এরদোয়ান তুরস্ককে রুগ্ন অবস্থা থেকে এখন একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন।
এরদোয়ানের রাজনৈতিক কৌশলের একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হল হিপোক্রেসি এবং বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক বয়ান তৈরি।
কয়েকটা উদাহরণ দিই।
এরদোয়ান প্রায়ই জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি তুরস্ককে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নিতে চান। ২০১১ সালের পর থেকে তার কথার সাথে তার কাজের কোনো মিল নেই বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের সাথে তিনি সম্পর্ককে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন, তুরস্ক আর কখনোই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে বলে মনে হয় না। বিশেষভাবে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের সাথে তিনি যে ধরনের রেটোরিক তৈরি করেছেন, তাতে এই রাষ্ট্রগুলোকে সরাসরি ক্রুসেডার বলতেই শুধু বাকি আছে। ইউরোপের কাছে এরদোয়ান একটা বিরাট সমস্যার নাম।
এরদোয়ান কথায় কথায় সংবিধান, জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে তিনি যে দ্বিধাহীনভাবে সেক্যুলারিজমের অনুগত তা তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এর সাথে বাস্তবে তার কাজের কোনো মিল নেই। তার প্রায় এক প্রজন্ম ধরা শাসনকালে তুরস্কে সবচে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেক্যুলারিজম। পাশাপাশি তিনি সেক্যুলারিজমের যে বয়ান দাড় করিয়েছেন, সেই বয়ান চার্চ ও স্টেটের সেপারেশন তথা রাজনীতি ও ধর্মের পৃথকীকরণের যে ধারণা মূল সেক্যুলারিজম দেয়, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
নিজেকে জাতীয়তাবাদের অনুগত বলে প্রচার করলেও এরদোয়ান জাতীয়তাবাদের যে ধারণাটা প্রচার করেন, যেভাবে মিসরি, ফিলিস্তিনি, সোমালি, রোহিঙ্গা ও সুদানি-কাতারিদেরকে ভাই বলে সম্বোধন করেন এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁদের পাশে দাঁড়ান; তাতে তিনি আসলে প্যান ইসলামিক ন্যাশনালিজমে বিশ্বাসী কি না সেই সন্দেহ যে কোনো বিশ্লেষকের মনে উদয় হওয়া অসম্ভব না। এ কারণেই জন বোল্টন, শেলডন এডেলসন এবং এই ধরনের ফার রাইট ইভানজেলিক্যাল অথবা জায়োনিস্টরা মনে করে যে, তিনি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চান।
এরদোয়ান ইজরায়েলের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করেন না; বরঞ্চ ব্যবসা চালিয়ে যান। আবার এই সুযোগ নিয়ে তিনি গাজায় ত্রাণ পাঠান, হামাসকে সহায়তা করেন। ২০১৩ সাল থেকে বিষয়টা নিয়ে ইজরায়েল হাইয়োম নামের বিখ্যাত পত্রিকাটি উদ্বেগ প্রকাশ করছে; যার মালিক হলেন শেলডন এডেলসন, ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ মার্কিন নিওকন রাজনীতিতে যিনি জায়োনিস্টদের প্রভাবকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন।
এরদোয়ান ভবিষ্যতে কী করতে চান তা পরিষ্কার নয়।
তবে ২০০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তাঁর কাজের যে ধারাবাহিকতা, তা থেকে এটা অনুমান করা অসম্ভব নয়, তিনি তুরস্কের জনপরিসর ও ক্ষমতা কাঠামোতে ইসলামকে শক্তিশালী এক অবস্থানে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন; কিন্তু কাজ করছেন সেক্যুলারিজমের কাঠামোর ভেতরে থেকেই। তার বৃহত্তর লক্ষ্য হল তুরস্ককে বিশ্বরাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। জেরুসালেম পোস্ট, ইজরায়েল হাইয়োম, হারেৎজ, সিবিএন, ফক্স, ফরেন পলিসি সবাই কমপক্ষে একবার হলেও মন্তব্য করেছে, এরদোয়ান উসমানি খিলাফাহকে ফিরিয়ে আনতে চান। কিন্তু এরদোয়ান নিজে বলেন, তিনি চান সেক্যুলারিজম। আবার তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা হলো আরেকরকম। একদিকে তিনি পশ্চিমা স্ট্যান্ডার্ড ও রেটোরিককে প্রত্যাখ্যান করেন আবার পশ্চিমকে মৌখিকভাবে আক্রমণ করার সময় সেই পশ্চিমা রেটোরিকই তিনি ব্যবহার করেন।
পশ্চিম না পারে তাকে ফেলতে, না পারে গিলতে। তিনি ইসলামিস্ট না, তিনি সেক্যুলারও না; তিনি একজন গ্লোরিয়াস হিপোক্রেট এবং এটাই তার প্রতিদ্বন্দীদের জন্য তাকে মোকাবিলা করার সবচে বড় অসুবিধা।
অপেক্ষায় রইলাম, দেখি আগামীর ইসলামী দুনিয়ায় জনাব রজব তৈয়ব এরদোয়ান এর কতটুকু ভূমিকা থাকে।
লিখেছেনঃ মুহম্মদ সফিকুল ইসলাম।
লিখেছেনঃ মুহম্মদ সফিকুল ইসলাম।
খবর বিভাগঃ
আন্তর্জাতিক
ইতিহাস
তুরস্ক
মতামত
0 facebook: