06 August 2019

মোদির আচরণ প্রমান করছে কাশ্মীর এখন ভারতের অধিকৃত পশ্চিমতীরঃ মিহির শর্মা


আন্তর্জাতিক ডেস্ক।। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রায়ই দাবি করে আসছে, তাদের পদক্ষেপগুলো নজিরবিহীন। তারা যা করে দেখিয়েছে, ভারতের ইতিহাসে কোনো সরকারের এমন দুঃসাহস হয়নি।

তাদের কার্যক্রমকে অধিকাংশ সময় মৃদুস্বরে বাড়াবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আগের সরকারগুলো যা-কিছু করে দেখিয়েছে, সব কিছুকে ছাপিয়ে সোমবার বহুদূরে চলে গেছে তারা। জম্মু ও কাশ্মীরকে নিয়ে তারা যা করেছে, তা অবশ্যই বড় থেকে আরও বড় সমস্যা।

মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যটিতে উত্তেজনা ক্রমাগত ও রূঢ়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ তীর্থযাত্রা বাতিলের পর সেখানে সেনাদের ঢল নামে। কাশ্মীরের রাজনীতিবিদদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। মোদির ডান হাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে কাশ্মীরসংশ্লিষ্ট একগুচ্ছ আইনি পরিবর্তনের ঘোষণা দেন।

যার মর্মকথা হচ্ছে- সাত দশক আগে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময় প্রতিশ্রুত বিশেষ মর্যাদা বাতিল, রাজ্যটি দুটি ভাগে বিভক্ত, আইন প্রণয়ন ও স্থানীয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে।

ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের একটি রাজ্য হিসেবে যে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার পাওয়ার কথা, তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। কাশ্মীর এখন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের একটি ভূখণ্ড মাত্র।

কাজেই দশকের পর দশক ধরে নিপীড়নের শিকার রাজ্যটিকে এখন আইন পাস ও অনুমতির জন্য নয়াদিল্লি সরকারের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

সম্ভবত ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এ পরিবর্তনগুলোয় সমর্থন দেবে না। যদি আদালতও সায় দেন, তবে সত্যিই তা হবে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

ভারতের কোনো সরকারই এই নাজুক আইনি ভারসাম্যে, যেটির ওপর ভিত্তি করে উপত্যকাটি ভারত নিজের বলে দাবি করছে, সেটিতে ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি। সেখানকার অধিবাসীরা এখন ক্ষোভে ফুঁসছেন।

তাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ন চলছে। ভূস্বর্গ বলে খ্যাত রাজ্যটির গ্রাম ও বাসিন্দাদের বাড়িতে সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে। এখন নিজেদের চোখের সামনে দিয়ে স্বায়ত্তশাসন ও পরিচয় কেড়ে নেয়া হয়েছে।

কাশ্মীরি ও ভারতীয়দের জন্য এই পরিবর্তনের অর্থ কী দাঁড়ায়? যদি এগুলো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তখন একটা বড় পরিবর্তন দেখা যাবে।

আগে কেবল কাশ্মীরি লোকজন সেখানে ভূমির মালিক হতে পারতেন, এখন রাজ্যের বাইরে থেকে দখলদারদের ঢল আসবে।

ভারত এর আগে কখনও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক তাস খেলেনি। কাশ্মীরিদের দাবি-দাওয়া মেটাতে অন্যত্র এই সংখ্যা ব্যবহার করেছে। হান চাইনিজদের তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ে চলে আসতে উৎসাহিত করার মতোই চীনা কৌশল কাশ্মীরে অবলম্বন করেছে ভারত।

কাজেই জিনজিয়াং কিংবা তিব্বতের মতো বিচ্ছিন্ন আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল অথবা অধিকৃত পশ্চিমতীরের মতো কাশ্মীরও একটি ভূখণ্ড হয়ে যায় কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়।

দেখা যাবে, যেখানে স্বৈরাচারী শাসনের শিকার হওয়া অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতিসুরক্ষিত উপনিবেশে সশস্ত্র দখলদাররা নির্বিঘ্নে বসবাস করছে। কাশ্মীরিদের ভাগ্যে এমনটিই সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প।

কিন্তু ভারতের জন্য তা কখনই ইতিবাচক হয়ে আসবে না। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী উদার গণতান্ত্রিক দেশের মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে ভারতের। কিন্তু কাশ্মীরকে যদি জিনজিয়াং কিংবা অধিকৃত পশ্চিমতীরের মতো একটি ভূখণ্ড তৈরি করে, সেখানকার লোকজনকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বে নামিয়ে আনে এবং তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পের ভেতর আটকে রাখে, তবে সেই মর্যাদা পাবে না হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি।

ক্ষুব্ধ বিদ্রোহের মোকাবেলার করার মতো সম্পদ ভারতীয় নাগরিক কিংবা অর্থনীতির নেই।

এতে ভারতের অন্য বিদ্রোহী অংশগুলোতে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক আঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়ে যাবে। উত্তর ও পশ্চিমে মোদির কেন্দ্রভূমিগুলোর থেকে যেটি একেবারে বিপরীত। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক খেলায় এসব অঞ্চলের অধিবাসীদের সংখ্যা কমে যাবে। ইতিমধ্যে বহিরাগতদের চাকরিতে নিয়োগ বন্ধে দেশটির বিভিন্ন রাজ্য আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।

বড় ধরনের বসতি স্থাপনের আশঙ্কা ভারতের অন্যত্র আধা-জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলবে। নয়াদিল্লির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা মোটেও কাম্য হতে পারে না।

কিন্তু উপত্যকাটি ঘিরে মোদি যা করেছে, তা ভারতের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গেও যায় না। এতে কেবল উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শই প্রতিষ্ঠিত হবে। বিজেপির মতাদর্শের গভীরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদই হচ্ছে মূল কথা।

ভারতের একমাত্র মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীর। এতে উপত্যকাটির স্বায়ত্তশাসন মোদির বিজেপি ও দলটির অনুসারীদের জন্য মারাত্মক পীড়াদায়ক।

ইসরাইল বহু জাতিগত গণতান্ত্রিক কোনো দেশ নয়, বরং সন্ত্রাসী ও ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র, যেটি জানে মুসলমানদের ওপর কীভাবে নিপীড়ন চালাতে হয়। এটিই তাদের চিরায়ত মতাদর্শ।

এখানে সাধারণ একটি নির্বাচনী হিসাবও রয়েছে। যখনই সেখানে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেবে, নির্বাচনে বিজেপি তখন ভালো করবে।

ভারতের অর্থনীতিতে দৃশ্যত একটা বাজে অবস্থা চলছে। অন্যান্য জনপ্রিয়তাবাদী একনায়কদের মতো, মোদিও এটিকে তার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে উপযুক্ত মুহূর্ত হিসেবেই দেখবে।

কাশ্মীর ও ভারতের ট্র্যাজেডি হচ্ছে- সেখানকার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাস্তবিক কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। পার্লামেন্টে মোদির সংখ্যাগরিষ্ঠতা এতটাই বেশি, যা দিয়ে নয়াদিল্লিতে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলতে পারবে।

দেশটির গণমাধ্যমের অধিকাংশেরই লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। সংবাদপত্রের মুখ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া কিংবা কিনে ফেলা হয়েছে। আর স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের এমনভাবে সীমিত করা হয়েছে, যাতে তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে।

কাশ্মীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতারাও সহানুভূতিসম্পন্ন মুখপাত্র হতে পারেনি। তাদের মধ্যে যারা দুর্নীতিগ্রস্ত না, আপস করেছে কিংবা আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট উগ্রপন্থী, কেউ-ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি।

দেশের বাইরে থেকেও শুরু থেকে বাস্তবিক কোনো চাপ আসেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উদার গণতন্ত্রের চেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ শাসনকেই বেশি পছন্দ করেন। জিনজিয়াংয়ের জন্য কেউ কি এগিয়ে এসেছিল? নাহ, কেউ আসেনি। বরং চীনের কাছে তারা কাপুরুষের মতো নতিস্বীকার করেছে।

কাজেই ভারত যদি কাশ্মীরের প্রতি একই আচরণ করে, তবে ভারতকে কেউ একঘরে করবে বলে মোদির আশাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

ভারতকে এই নিচে নামানোতে যারা স্বীকৃতি দিয়েছেন, তাদের সবাই কেবল এক ব্যক্তির দিকেই তাকিয়ে আছেন। তিনি ভারতের সাংবিধানিক ভিত্তি ও ইউনিয়নকে দুর্বল করে দিয়েছেন এবং লোকজনকে নৃশংস করে তুলেছেন। কিন্তু যারা একটু প্রতিবাদী হয়ে উঠতে চেষ্টা করছেন, তারাও শ্বাসরোধ বোধ করতে শুরু করেছেন।

লেখকঃ মিহির শর্মা, ব্লুমবার্গ নিউজের কলাম লেখক, এ ছাড়া ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডেও নিয়মিত লিখছেন তিনি। রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমিবইয়ের লেখক এই অর্থনীতিবিদ


শেয়ার করুন

0 facebook: