ধর্মীয় ডেস্কঃ আজ ১২ই রবিউল আউওয়াল (২১ নভেম্বর) মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঈদ, ঈদে আযম, ঈদে মীলাদুন নবী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যথাযোগ্য মর্যাদা ও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পবিত্র ঈদে মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক আয়োজন করা হয় এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করার জন্য। তবে সবচেয়ে ব্যতিক্রম ও নতুন ধারায় দিবসটি উদযাপন করে সাইয়াদুল আ’ইয়াদ শরীফ আন্তর্জাতিক উদযাপন কমিটি নামক একটি সংগঠন। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মুহম্মদিয়া জামেয়া শরীফ মাদরাসা ও রাজারবাদ দরবার শরীফের সম্মুখে ‘কোটি কণ্ঠে মীলাদ শরীফ’ নামে তাঁরা আয়োজন করেন এক বিশাল মানবপ্রাচীর এবং ঘন্টাব্যাপী ছিলো পবিত্র মীলাদ শরীফ পাঠের আয়োজন। মীলাদ শরীফ পাঠ শেষে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য জুলুস। প্রায় ১ ঘন্টা সময়ব্যাপী মিলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম (দাড়িয়ে সালাম পেশ) করেন মুহম্মদ মাবরুরুল হক ফুয়াদ।
অনুষ্ঠান আয়োজকদের মধ্যে
মুহম্মদ শামিম বলেন, হিজরী
সনের রবিউল আউওয়াল মাসের ১২ তারিখ যে পবিত্র দিনে পৃথিবীর বুকে আগমন করেন আমাদের
প্রাণপ্রিয় নবীজি রসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সেই দিনটিকে স্বরন
করে, আমাদের
প্রাণপ্রিয় নবীজি রসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সম্মান
প্রদর্শন করে আয়োজন করা হয়েছে এই ‘কোটি
কন্ঠে মীলাদ শরীফ’ অনুষ্ঠানটি।
আয়োজক কমিটির সদস্য মুনজির মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন বলেন, আমরা
নূর নবীজীর আগমন দিবসে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান একত্রিত হয়ে নবীজীকে ছলাত-সালাম
পেশ করবো, ঈদে
মিলাদের দিনে এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? আর এই মহতী আয়োজনে যেন সারাদেশ ও সারা
বিশ্ব থেকে মুসলমানগণ অংশগ্রহণ করতে পারে, এজন্য আমরা www.meelaadshareef.com নামক
একটি ওয়েবসাইটে এবং ফেসবুকে MeelaadShareef
নামক পেইজের মাধ্যমে লাইভ ব্রডকাস্ট (সরাসরি
সম্প্রচার) করছি। এর মাধ্যমেই কোটি কন্ঠের মিলাদ শরীফ অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন অগণিত
ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
ঈদে মিলাদুন নবী আরবি
তিনটি শব্দের সম্মিলিত রূপ। ঈদ,
মিলাদ ও নবী এই তিনটি শব্দ নিয়ে এটি গঠিত। আভিধানিক অর্থে ঈদ
অর্থ খুশি, মিলাদ
অর্থ জন্ম, নবী
অর্থ বার্তাবাহক। পারিভাষিক অর্থে মহানবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের জন্মের আনন্দকে ঈদে মিলাদুন নবী বলা হয়। অন্য কথায়, ঈদে
মিলাদুন নবী হলো, রাহমাতুল্লিল
আলামিন হজরত মুহম্মদ মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র ‘বিলাদত
শরিফ’ উপলক্ষে
খুশি প্রকাশ করা। আর মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমন স্মরণে
খুশি প্রকাশ করে মিলাদ শরিফ মাহফিলের ব্যবস্থা করা, শান-মান, মর্যাদা-মর্তবা আলোচনা করা, কুরআন
তেলাওয়াত, দরুদ
শরিফ পাঠ, তাওয়াল্লুদ
বা জন্মকালীন ঘটনা মজলিস করে আলোচনা করা, দাঁড়িয়ে সালাম, কাসিদা
বা প্রশংসামূলক কবিতা, ওয়াজ-নসিহত, দোয়া-মোনাজাত, সম্ভব
মতো মেহমান নেওয়াজির সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করা। হাদিস শরিফে মহানবী ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মকাল সম্পর্কে জানা যায়। হজরত আবু কাতাদা আল আনসারি রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সোমবার দিন রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে
তিনি বলেন, ‘এ
দিনে (সোমবারে) আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনেই আমি নবুয়ত পেয়েছি।’ (মুসলিম)।
ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন ইসহাক (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এর মতে, রাসূল
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমুল ফিল বা পবিত্র কাবা শরীফে হস্তির আক্রমনের
সালের (৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে) রবিউল আউয়াল শরীফ মাসে ১২ তারিখ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। নবী
করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার রোজা রেখে নিজের জন্মদিন স্মরণ করতেন।
এর দ্বারা ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়।
তাই এই মুবারক মাসের ১২ তারিখ
উম্মাহর জন্য শ্রেষ্ঠতম দিন। কারণ,
এ মুবারক দিনটি যদি আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শুভাগমনের অন্তর্ভুক্ত না হতো তাহলে শবে ক্বদর, শবে
বরাত, ঈদুল
ফিতর, ঈদুল
আযহা, জুমা
ইত্যাদি ফযীলতপূর্ণ কোন দিন-রাতেরই আগমন ঘটতো না। শুধু তাই নয়, কুরআন
শরীফ নাযিল হতো না, দ্বীন
ইসলাম আসতো না এবং কোন মমিন-মুসলমানের অস্তিত্বও থাকতো না। আর রাসুলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার জন্য ‘ফালইয়াফরাহু’ তথা
খুশি মুবারক প্রকাশ করা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ পাক
রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআরে ইরশাদ করেনঃ [وَمَا
خَلَقْتُ الْـجِنَّ
وَالْاِنْسَ اِلَّا
لِيَعْبُدُوْنِ]
অর্থঃ “আমি
জিন ও ইনসানকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।” (পবিত্র
সূরা যারিয়াত শরীফঃ আয়াত শরীফ ৫৬)
এখন ইবাদত বা আমলের
মধ্যে কোন ইবাদত বা আমল সর্বশ্রেষ্ঠ তা মহান আল্লাহ পাক তিনিই ভালো জানেন। এবং তা
প্রকাশ করার লক্ষ্যে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেনঃ [يَا
اَيُّهَا النَّاسُ
قَدْ جَاءَتْكُمْ
مَّوْعِظَةٌ مّن
رَّبّكُمْ وَشِفَاءٌ
لّمَا فِي
الصُّدُوْرِ وَهُدًى
وَرَحْـمَةٌ لّلْمُؤْمِنِيْنَ
◌ قُلْ بِفَضْلِ
اللهِ وَبِرَحْـمَتِهه
فَبِذٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوْا
هُوَ خَيْرٌ
مّـمَّا يَـجْمَعُوْنَ]
অর্থঃ “হে
মানবজাতি! অবশ্যই মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে তোমাদের মধ্যে তাশরীফ মুবারক
এনেছেন মহান নছীহত মুবারক দানকারী,
তোমাদের অন্তরের সকল ব্যাধিসমূহ শিফা মুবারক দানকারী, কুল-কায়িনাতের
মহান হিদায়েত মুবারক দানকারী ও খাছভাবে ঈমানদারদের জন্য, আমভাবে
সমস্ত কায়িনাতের জন্য মহান রহমত মুবারক দানকারী (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম! আপনি উম্মাহকে বলে দিন,
মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার সম্মানিত ফদ্বল বা অনুগ্রহ মুবারক ও
সম্মানিত রহমত মুবারক হিসেবে উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে
হাদিয়া মুবারক করেছেন; সেজন্য
তারা যেনো সম্মানিত ঈদ উদযাপন তথা খুশি মুবারক প্রকাশ করে। এই খুশি মুবারক প্রকাশ
বা ঈদ করাটা সেসব কিছু থেকে উত্তম,
যা তারা দুনিয়া-আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে।” (পবিত্র
সূরা ইঊনুস শরীফঃ আয়াত শরীফ ৫৭-৫৮)
অর্থাৎ فَلْيَفْرَحُوْا ‘ফালইয়াফরাহু’ বা
খুশি প্রকাশ করা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত বা আমল। আর এই فَلْيَفْرَحُوْا ‘ফালইয়াফরাহু’ বা
খুশি প্রকাশ করার বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন,
هُوَ
خَيْرٌ مِّمَّا
يَجْمَعُونَ
অর্থাৎ “এই
খুশি প্রকাশ করাটা হবে বান্দা-বান্দির জন্য সব কিছু থেকে উত্তম, যা
তারা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য জমা করে রাখে।”
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত
শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম
উনার জন্য “ফালইয়াফরাহু” তথা
খুশী মুবারক প্রকাশ করা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত।
এদিকে মহান আল্লাহ পাক
রব্বুল আলামীন সূরা কাওছার-এ ইরশাদ করেন, (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম!) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওছার দান করেছি।’ ‘কাওছার’-এর অনেক অর্থ রয়েছে, তার
মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে খইরে কাছির অর্থাৎ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ পাক সমস্ত ভাল উত্তম এবং শ্রেষ্ঠ বিষয় ও জিনিসগুলো
হাদিয়া করেছেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সম্পর্কযুক্ত
ও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই মুসলমান সম্প্রদায় দিনটি পবিত্র ঈদে
মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিসেবে পালন করেন ।
ইবনে কাছির রহমতুল্লাহি
আলাইহি তাফসীর গ্রন্থের মিলাদে মোস্তফা অধ্যায়ে (২৯/৩০ পৃষ্টায়) উল্লেখ করা হয়েছে, নবম
হিজরিতে তাবুকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতে
পেলেন, হজরত
আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার হুজরায় মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম (সম্ভবত) কবিতা আকারে পাঠ করছেন। রাসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তা দেখে মন্তব্য করেন,
‘তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত অনিবার্য হয়ে গেল।’ রাসূলে
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ মন্তব্য থেকেই বোঝা গেল, ঈদে
মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষে আনন্দ ও আলোচনা করলে রাসূল ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শাফায়াত পাওয়া যাবে নিশ্চিতভাবে। অন্য কোনো পন্থায় এত সহজে
শাফায়াত পাওয়ার পদ্ধতি বিরল। বক্তারা বলেন, আবু লাহাব ছিল রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর প্রকাশ্য ও বড় শত্রু, যার ধ্বংসের কথা আল্লাহ স্বয়ং সূরা
লাহাবে বলেছেন। কিন্তু রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের খবরে খুশি
হয়ে আবু লাহাব এক নির্দেশে তার এক দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিল। এ কারণে আবু লাহাব
কবরে প্রতি সোমবার তার নির্দেশ দেয়া আঙুল থেকে প্রবাহিত পানি পানের সুযোগ পায় এবং
কবরের আজাব হাল্কা হয়। রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির মূল
এবং আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতে আকবর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বোচ্চ এ নেয়ামতের
জন্য খুশি প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, এ নিয়ামতের খুশি সঞ্চিত সকল এবাদত হতে
উত্তম। এরপরও এজিদের উত্তরসুরিরা আজ ঈদে মিলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে বিদায়াত বলে গলাবাজি করে সাধারণ মুসলমানদেরকে নাজাতের বড় ওছিলা থেকে
বঞ্চিত করছে।
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
জাতীয়
ধর্ম ও জীবন
0 facebook: