দূর্জয় সিংহ
চৌধুরীঃ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে নতুন করে ভাঙ্গনের সূর উঠেছে ঢাকা উত্তর সিটি
কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে। আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষ থেকে দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর সেলিম
উদ্দীনকে প্রার্থী ঘোষণার পর হতে ২০ দলীয় জোটে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। হঠাৎ করে জামায়াতের দলীয়
প্রার্থী ঘোষণায় বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। অন্যদিকে এই ভাঙ্গণের সুবিধা তুলতে চাইছে ক্ষমতাসীন দল
আওয়ামীলীগ। জামায়াত ২০ দলীয় জোটে থাকবে
নাকি নতুন কোনো দলের সাথে জোট বাঁধবে এই নিয়ে ভাবছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে জোট বাঁধার ক্ষেত্রে জাপা-জামায়াত
এক হওয়ার বিষয়টি জোরালো হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতাদের মন্তব্যে। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াত ও সৈরাচার সরকার
হিসেবে জাতীয় পার্টিকে মনে করা হলেও উভয় দলই আওয়ামীলীগ ও বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার
সিঁড়ি হিসেবে পরিচিত।
বিএনপি-জামায়াত
জোট সরকারের আমলের বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট জামায়াত নেতার মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত
থাকার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই সময় রাজপথের আন্দোলনে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোনো সমর্থন না পাওয়ায়
তৃণমূলের জামায়াত নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্দ। এছাড়া ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারী বিএনপি-জামায়াত জোট গণতন্ত্র
হত্যা দিবস পালন করার ঘোষণা দিয়েও বিএনপি মাঠে ছিলো না দাবি দলটির কেন্দ্রীয়
নেতাদের। সেই সময় বিএনপিকে ঢাকার কোথাও
কর্মসূচী পালন করতে দেখা না গেলেও জামায়াত রাজধানীর দুয়েকটি স্থানে মিছিল বের
করেছিল। এসময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ ও
হতাহতের ঘটনা ঘটে। তখন থেকেই বিএনপির সাথে তাদের অন্যতম শরীক জামায়াতের দূরত্ব বাড়তে থাকে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হলে
নতুনরা নেতৃত্বে আসে। এরপর থেকেই দলের নীতি নির্ধারকরা নতুন করে দল সাজাতে চাইছেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একাদিক
নেতা জানান, জামায়াত রাজপথের আন্দোলনে নামলেও তাদের মিত্র বিএনপির
নেতাকর্মীদের তৎপরতা দেখা যায় না। জেলা-উপজেলায় বিএনপির একাধিক কমিটি, গ্রুপ-উপগ্রুপ
থাকায় ২০ দলীয় জোট আন্দোলনে সফল হতে পারছে না। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা লুটপাট, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকলেও এখন রাজপথের আন্দোলনে
তারা সক্রীয় নয়। এই জামায়াত নেতারা মনে করছেন, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি
হিসেবে জামায়াতকে ব্যবহার করতে চাইছে। জামায়াতের তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে
ইতিমধ্যেই একটি বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। গত পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন নির্বাচনে
জোটগতভাবে প্রার্থী না দিয়ে বিএনপি নিজ দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় জামায়াতের
শক্তিশালী প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বিএনপির প্রার্থী থাকায় জামায়াত মনোনীত প্রার্থী
পরাজিত হয়েছেন বলে দাবি করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাই আসন্ন সকল নির্বাচনে শক্তি বিবেচনা করে জামায়াতের
আলাদা দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পরামর্শ দিয়ে একটি বার্তা কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে
জানিয়েছে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। প্রয়োজনে জোটের বাইরে এসে নির্বাচন করার পক্ষেও মত তাদের।
দলটির নেতারা
তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা, রাজশাহী ও
সিলেট সিটি নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দেয়ার কথা ভাবছে। ইতিমধ্যেই তারা জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্র শিবিরের
সাবেক সভাপতি ও ২০১৭ সালের শুরুতে জামায়াতের মহানগর শাখা দুই ভাগ হওয়ার পর উত্তরের
আমির সেলিম উদ্দিনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। এই প্রার্থী ঘোষণায় অনেকটা স্তম্ভিত বিএনপি ও জোটের অন্য
শরিকরা। জোটগতভাবে একক প্রার্থী মনোনয়ন
করতে একাধিক বৈঠকও করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। গতকাল রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা
আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বড় ছেলে তাবিথ আউয়ালকে প্রার্থী হিসেবে চুড়ান্ত করা হয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এক নেতা জানান, বিএনপি চায় জোট
থেকে একজন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্ধন্দ্বিতা করুক। তাই জোটের অন্যান্য শরিকদের সাথে বৈঠক করে এই
সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তাবিথ আউয়ালকে বিএনপি-জোটের প্রার্থী করার ব্যাপারে তিনি বলেন, জোটের একাধিক শরিকরা চাইছেন তাবিথকে প্রার্থী করা হোক। তবে সবার সাথে আলোচনা করেই
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যদিও জামায়াতের সাথে এখনো দন্ধ রয়েছে এই ব্যপারে।
গত ১০ জানুয়ারী
বকশীবাজর অস্থায়ী আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আব্দুল আউয়াল মিন্টুও
তাবিথ আউয়ালকে জোটের প্রার্থী করার বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার অনেক বয়স হয়েছে। রাতদিন আমি সময় দিতে পারবো না। তাছাড়া তাবিথ আমার চেয়ে ভালো কাজ করতে পারবে। তাবিথই ঢাকা উত্তর সিটি
করপোরেশনের জন্য যোগ্য প্রার্থী।
এদিকে বর্তমান
সংসদের প্রধান বিরোধী দল হলেও জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামীলীগের ইশারায়
রাজনীতি করছে। ২০১৪ সালের ৫ মে নির্বাচনে
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলেও শেষ
পর্যন্ত চাপের মুখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিরোধী দলে থেকেও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীপরিষদের
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাপার কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই
চেয়েছিলেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের অনেক ত্যাগী ও দীর্ঘদিনের
পরীক্ষিত নেতারা নির্বাচন করতে পারেননি দলের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের কারণে। এনিয়ে ক্ষুব্দ আছেন অনেক নেতা। আওয়ামালীগের সাথে থাকলেও
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার স্বাদ পায়নি দলটি। একারণে আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চাইছে দলটি। এছাড়া রংপুর সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় অনেকটা চাঙ্গা হচ্ছে জাপার তৃণমূলের
নেতাকর্মীরা। তবে ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী
দিয়ে জাপার সরকার গঠন করা অসম্ভব মনে করছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাই জাপার নেতৃত্বে অন্য কোনো
বৃহৎ দলের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচন করার চিন্তাও করছে দলটি। জামায়াতের সাথে জোট বাঁধার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে জাপার
এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের বক্তব্যে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টি আবার ক্ষমতায় যেতে চায়। মানুষের জন্য কাজ করতে চায়। দেশের মানুষের স্বার্থে জাপা-জামায়াত জোট হলে ক্ষতি
হবে না। জামায়াতের সাথে আওয়ামীলীগ-বিএনপি
উভয় দলেররই জোট বাঁধার ইতিহাস রয়েছে। জাপার নেতৃত্বে জোট হলে যদি দেশের মানুষের কল্যাণ হয় তাহলে অসুবিধা নেই।
বিএনপি নেতারা
এখনো নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া নির্বাচন করবে না বলে বিভিন্ন সমাবেশে
বক্তব্য দিচ্ছেন। ফলে সংসদে শক্তিশালী বিরোধীদল নিয়েও ভাবছে আওয়ামীলীগ। জাপা-জামায়াত জোট হলে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল পাবে
আওয়ামীলীগ। আর জাপা-জামায়াত জোট হয়ে
নির্বাচনে গেলে বিএনপির সোচনীয় পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে তৃণমূলের জাপা-জামায়াত
নেতাকর্মীদের ধারণা। গত নির্বাচনের মতো বিএনপি জোট নির্বাচনে না গেলে বহির্বিশ্বের কাছে নির্বাচন
প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষমতাসীন দলও ভিতরে ভিতরে চাইছে জাপা-জামায়াত জোট হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ
করুক। কেন্দ্রীয় আওয়ামীলগের
গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এক মন্ত্রীও এমনটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। নামপ্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সরকার চাইছে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন হোক। তবে বিএনপি বারবার নির্বাচনে
না যাওয়ার পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছে। জাপা এখন বিএনপির চেয়েও শক্তিশালী দল। তারা যদি অন্য দলের সাথে জোট করে নির্বাচন করে তাতে
আওয়ামীলীগের সমস্যা হবে না। তবে আশা করি বিএনপি আগেরবারের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।
0 facebook: