05 June 2018

ইতিকাফ কি ও ইতিকাফের প্রয়োজনীয় মাসলা মাসায়েল


ইতিকাফ আরবি শব্দ আকফ এর মূল ধাতু থেকে নির্গত। এর অর্থ হচ্ছে অবস্থান করা। যে মসজিদে জামায়াতের সঙ্গে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়, এমন মসজিদে মহান আল্লাহ তায়ালা উনার ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে।

ইতিকাফের নিয়ম হলো, পাক-পবিত্র হয়ে নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ত করে মসজিদে বা নামাজের নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করা। পুরুষের ইতিকাফের জন্য এমন মসজিদ হতে হবে, যেখানে অন্তত নিয়মিত আজান ও ইকামতের সঙ্গে জামাতে ৫ ওয়াক্ত পবিত্র নামাজ আদায় করা হয়।

ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদুল হারাম শরীফ বা বায়তুল্লাহ শরীফ। এরপর মসজিদে নববী শরীফ, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফ, তারপর জামে মসজিদের
মধ্যে যে মসজিদে মুসল্লি সংখ্যা বেশি সেই মসজিদ।

স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো নিজ নিজ ঘরের পবিত্র নামাজের নির্ধারিত স্থান। এ স্থানটা এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, যেখানে পর্দা ও সার্বিক নিরাপত্তার যাবতীয় শর্ত বিরাজমান। মহিলাদের ইতিকাফের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শর্ত হলো স্বামীর অনুমতি নেয়া ।

পবিত্র রমাদ্বান শরীফের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফের বিরাট একটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে উম্মতে মুহম্মদির ওপর অর্পিত মহান আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির উদ্দেশ্য। এ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্বয়ং নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সকল পবিত্র রমাদ্বান শরীফে ইতিকাফ করেছেন এবং উম্মতের জন্য নির্ধারিত করে গেছেন, রমাদ্বান শরীফের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতের যেকোন এক রাতই এই মহিমান্বিত রাত।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র রমাদ্বান শরীফের প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলেন, তারপর তিনি দ্বিতীয় ১০ দিনেও ইতিকাফ করলেন। এ সময় তিনি তুর্কি তাঁবুর নিচে অবস্থান করছিলেন। তাঁবু থেকে মাথা বের করে বললেন, ‘আমি এ রাতটি অর্থাৎ পবিত্র শবে কদরের সন্ধানে প্রথম ১০ দিনের ইতিকাফ করলাম, তারপর মধ্যের ১০ দিনও ইতিকাফ করলাম, তারপর হযরত জিবরীলে আমিন আলাইহি সালাম দ্বারা আমাকে জানানো হলো, এ রাতটি শেষ ১০ দিনেই নিহিত রয়েছে; সুতরাং আমার সঙ্গে যারা ইতিকাফ করেছে, তাদের শেষ ১০ দিনেও ইতিকাফ করা উচিত।

অন্য এক হাদিস শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র রমাদ্বান শরীফের ১০ দিন ইতিকাফ করে, সে দুটি পবিত্র মাবরূর হজ্জ ও দুটি পবিত্র ওমরার সওয়াব লাভ করে(কাশফুল গুম্মাহ)।

ইতিকাফ অবস্থায় বিনা ওজরে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। মহিলাদের ক্ষেত্রেও একই হুকুম। তারাও ঘরের নির্ধারিত স্থান থেকে বের হতে পারবে না। তবে পেশাব-পায়খানা ও পবিত্র জুমুয়ার নামাজ আদায় ইত্যাদির প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ। ইতিকাফকারী ইতিকাফের স্থানেই ঘুমাবেন ও খাওয়া - দাওয়া করবেন।

অসুস্থ ব্যক্তির সেবার জন্য মসজিদ থেকে বের হলে, কোনো মৃত ব্যক্তিকে দেখার উদ্দেশ্যে বা তার জানাজায় শরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে, এমনকি পানিতে ডুবন্ত বা আগুনে নিমজ্জিত কোনো মানুষকে রক্ষা করার জন্য মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে অসুস্থতার কারণে সামান্য সময়ের জন্য মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ ফাসেদ হবে। ইতিকাফ ফাসেদ হওয়ার অন্য আরেকটি কারণ হলো সহবাস বা সহবাসের দিকে আকৃষ্টকারী কাজ করা, তা দিনেই হোক বা রাতেই হোক। স্বপ্নদোষে ইতিকাফ ফাসেদ হয় না। পাগল বা বেহুঁশ থাকার কারণে লাগাতার ইতিকাফ করতে না পারলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যায়।

পবিত্র পবিত্র রমাদ্বান শরীফের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নতে মোয়াক্কাদা কেফায়া। যারা ৩ দিন ইতিকাফ করার দ্বারা সুন্নত আদায় হয়ে যাবে বলে তাদের কথা সঠিক নয়। কেউ যদি পবিত্র রমাদ্বান শরীফের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতে চায় তাহলে সে ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করবে।
(সহহি বোখারি শরীফ, হাদিস নং ২০২৭, আদ্দুররুল মুখতার শরীফ, হাদিস নং ২/৪৪২)

মাসয়ালাঃ ইতিকাফ সহিহ হওয়ার জন্য শরিয়তের সংজ্ঞায় মসজিদ হওয়া শর্ত। (আল বাহরুর রায়েকঃ ৫/৪১৭)

মাসয়ালাঃ এক মহল্লায় একাধিক মসজিদ থাকলে প্রত্যেক মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম হলেও জরুরি নয়। বরং যেকোনো এক মসজিদে ইতিকাফ করলে মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়ে যাবে। স্থানীয় লোকের মধ্যে যে স্থানটি মহল্লা বা গ্রাম হিসাবে পরিচিত তাই মহল্লা বা গ্রামের পরিধি বা সীমা। (রদ্দুল মুহতারঃ ২/৪৪২, ২/৪৫, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়াঃ ১৭/১৬৯)

মাসয়ালাঃ কোনো গ্রামের মসজিদে অন্য গ্রামের লোকের ইতেকাফের দ্বারা ওই গ্রামের সবার পক্ষ থেকে ইতিকাফের সুন্নতে মোয়াক্কাদায়ে কেফায়া আদায় হয়ে যাবে। তবে গ্রামবাসীর জন্য উচিত তাদের মধ্য হতে কারো ইতিকাফে বসা। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়াঃ ১৭/১৭১)

মাসয়ালাঃ ইতিকাফ একটি মহৎ ইবাদত। এ ইবাদত প্রত্যেক মুসলমান স্বেচ্ছায় পালন করার চেষ্টা করতে হবে। ইসলামি শরিয়তে বিনিময় দিয়ে ভাড়া করে ইবাদত পালন করার কোনো সুযোগ নেই। টাকার বিনিময়ে ইতিকাফ করা এবং করানো সম্পূর্ণ নাজায়েয, এভাবে ইতিকাফ করানোর দ্বারা মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হবে না। (রদ্দুল মুহতারঃ ২/৫৯৫, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া ১৭/১৭১)

দশ দিনের কম ইতিকাফ

মাসয়ালাঃ আমাদের দেশের অনেক এলাকায় দেখা যায়, তারা পবিত্র রমাদ্বান শরীফের শেষ দশকের ইতিকাফ না করে শুধুমাত্র ২৭ তারিখে ইতিকাফ করে থাকে। এমনকি অনেক এলাকায় ২৭ তারিখের ইতিকাফ জরুরিও মনে করে। নফলের নিয়তে জরুরি মনে না করে ২৭ তারিখ বা অন্যকোনো দিনে ইতিকাফ করলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। অবশ্য শুধু ২৭ তারিখে ইতিকাফকে জরুরি মনে করার অবকাশ নেই। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ১/২১১, ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া, পৃষ্টা ৪৬১)

মাসয়ালাঃ যে ব্যক্তি সুন্নত ইতিকাফ শুরু করে ভেঙে ফেলেছে, পবিত্র রমাদ্বান শরীফের পর রোজাসহ একদিন ও এক রাত ইতেকাফ করবে। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫)

মাসয়ালাঃ যে নিয়মে নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র রমাদ্বান শরীফের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন, ঠিক সেভাবে আদায় করলেই তা সুন্নত ইতিকাফ বলে গণ্য হবে। এর বিপরীত কোনো শর্ত যুক্ত করলে তা নফল ইতিকাফ বলে বিবেচিত হবে, সুন্নত ইতিকাফ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ১/২১২, আহসানুল ফতওয়াঃ ৪/৫০৯)

মসজিদ থেকে বের হওয়া

মাসয়ালাঃ প্রাকৃতিক, মানবীয় ও শরয়ি প্রয়োজনে পবিত্র মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। যদি মসজিদের সীমানার ভিতরে অজুর ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে শুধু অজুর জন্য বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে। (আহসানুল ফাতাওয়াঃ ৪/৫১০)

মাসয়ালাঃ মসজিদের আদবের খেলাফ কোনো কাজ করা বা মুসল্লিদের ও ফেরেশতা আলাইহিস সালামদের কষ্ট হয়, এমন কোনো কাজ করার অনুমতি নেই। তাই নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী ইতিকাফকারী ব্যক্তি প্রয়োজনে বায়ু নির্গমনের জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ৫/৩৬১, ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ২/১৫২)

মাসয়ালাঃ শেষ দশকের সুন্নত ইতিকাফকারীর জন্য মানবীয় ও শরয়ি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নেই, বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে। সুতরাং ফরজ গোসল ছাড়া গরম ও গায়ের দুর্গন্ধের কারণে গোসল করার জন্য বের হওয়া জায়েয নেই। হ্যাঁ, যদি অতীব প্রয়োজন হয় এবং মসজিদে গোসলের পানি না পড়ার মতো গোসলের ব্যবস্থা থাকে তাহলে মসজিদেই গোসল করবে, অথবা ভিজা গামছা দিয়ে শরীর মুছে ফেলবে। আর প্রস্রাব-পায়খানা করতে গিয়ে অজু পরিমাণ স্বল্প সময়ের মধ্যে সাবান ইত্যাদি ছাড়া স্বাভাবিক গোসল করতেও কোনো অসুবিধা নেই। (রদ্দুল মুহতারঃ ২/৪৪০, ২/৪৪৫, আহসানুল ফাতাওয়াঃ ৪/৫১৫)

মাসয়ালাঃ পবিত্র রমাদ্বান শরীফে ইতিকাফকারী মসজিদের মোয়াজ্জিন হোক বা না হোক বিদ্যুত থাকুক বা না থাকুক সর্বাবস্থায় মসজিদের বাইরে গিয়ে আজান দিতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ১/২১২, রদ্দুল মুহতারঃ ২/৪৪৬)

মাসয়ালাঃ ইতিকাফকারীর জন্য যানাজা বা রোগী দেখার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নেই। তবে প্রস্রাব-পায়খানা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে বের হয়ে পথিমধ্যে রোগী দেখা এবং জানাজায় শরিক হওয়া জায়েয আছে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ১/২১২, মাআরিফুস সুনান: ৫/৫৪০)

বিঃদ্রঃ যারা ইতিকাফ এ বসতে চান তাদের আগামিকাল থেকে আসর এর পরে মাগরিবের আগে ইতিকাফ এ বসতে হবে।

লেখকঃ অনলাইন এক্টিভিস্ট ইসলামী গবেষক, মুহম্মদ হাসান।


শেয়ার করুন

0 facebook: