07 February 2018

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সুন্দর শহরে যত ভয়


আবু এন এম ওয়াহিদঃ তিউনিসিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টিউনিস-এলমানার’- আমি ২০০৬ সালে গিয়েছিলাম সেবার তিউনিস থেকে ফেরার পথে আমার বৈরুত হয়ে আসার কথা ছিল, কিন্তু কেন সেটা হয়ে ওঠেনি, তা এখন আর মনে নেইদশ বছর পর আবার যখন বৈরুত যাওয়ার সুযোগ এলো তখন ভাবলাম এবার আর কোনোক্রমেই এ মওকা হাতছাড়া করব নালেবানিজ আমেরিকান উইনিভার্সিটি (এলএইউ) আমার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে; দাওয়াত করেছে দুটো সেমিনার ও একটা খোলা আলোচনার জন্যতারিখ ঠিক হয়েছে এপ্রিলের ২০, ২০১৬বৈরুতমুখী যাত্রা হলেও আমার মূল গন্তব্য কিন্তু দুবাইদুদিনের কনফারেন্স এপ্রিল ১৭-১৮রওনা দেবো ১৫ তারিখটিকিটও করেছি সেভাবেই, ন্যাশভিল-দুবাই-ন্যাশভিলদুবাই থেকে বৈরুত যাওয়া-আসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছে ফ্লাই দুবাইএয়ারলাইন্সের সাথেযাবো ১৯ তারিখ, দুরাত থেকে ফিরব ২১ এপ্রিল, দুবাই হয়ে সোজা বাড়ি

বৈরুত নিয়ে সব সময়ই আমার মনে কৌতূহল ও উত্তেজনার সাথে সাথে একটা শঙ্কা এবং ভীতি কাজ করতএবার সফরের সময় যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, উত্তেজনা যেমন তেমনই রইল, কিন্তু ভীতি যেন আস্তে আস্তে ঘনীভূত হতে থাকলসফরসূচি চূড়ান্ত করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ফ্লাই দুবাই’-এর একটা ফ্লাইট রাশিয়াতে গিয়ে ক্র্যাশ করলবাষট্টিজন যাত্রীর মধ্যে কেউই বাঁচল নাশুনেই মনটা কেন জানি ছ্যাঁত করে উঠল, দিন পর তো আমাকেও উড়তে হবে ফ্লাই দুবাই’-এ! দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে একদিন রেডিওতে শুনলাম, বৈরুতে এক অস্ট্রেলীয় শিশুকে অপহরণ করা হয়েছেবুঝতেই পারছেন, আমার মনের অবস্থাটা কেমনযাবো কি যাবো না, ভাবতে শুরু করেছি, কিন্তু আমার ছেলে ও তার মাকে কিছু বলিনিআমি জানি, ঘরে এসব আলোচনা হলে এবারো আমার বৈরুত যাওয়া মাঠে মারা যাবেবড় মেয়ে তো আমার সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রেখেছে

যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, এমন সময় হঠাৎ একদিন ট্রাভেল এজেন্টের ই-মেইল পেলামলিখেছে, ‘ফ্লাই দুবাই’-এর বৈরুত ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছেআমি সাথে সাথে এলএইউ-কে জানালামতারা বলল, ‘‘চিন্তার কোনো কারণ নেই, অপেক্ষা করো, আমরা মিড্ল ইস্ট এয়ারলাইন্স’-এর টিকিট কিনে তোমাকে শিগগির জানাচ্ছিকয়েক দিনের মধ্যেই ফ্লাইট কনফার্মেশনসহ আইটিনারি চলে এলোআমিও মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, যাবোবাক্সপেটরা গোছানো হয়ে গেছেযাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে ঘটল আরেক ঘটনাএলএইউ আমার জন্য ১ মিলিয়ন ডলারের ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স কিনে তার কাগজপত্র ই-মেইল মারফত পাঠিয়েছেট্রাভেল ইন্স্যুরেন্সদেখেই তো আমার হৃৎকম্পন আবার বেড়ে গেলতার মানে বৈরুত সত্যি সত্যি একটি ভয়াবহ ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা, যাওয়ার আগে সবাইকে ইন্স্যুরেন্স কিনতে হয়, অর্থাৎ জীবনের নিরাপত্তা নেই!

এমন দোলাচলের মধ্যেই আল্লাহর ওপর ভরসা করে মন শক্ত করলাম এবং এপ্রিলের ১৫ তারিখ যথারীতি দুবাই-বৈরুতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লামদুবাইয়ের কাজ সেরে ১৯ তারিখ এয়ারপোর্ট গিয়ে যখন বৈরুতগামী মিড্ল ইস্ট এয়ারলাইন্সের (এটা লেবাননের ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার) বিমানে উঠলাম, তখন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের রূপমাধুর্য ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম এবং ভাবলাম, এমন সুন্দর সুন্দর মানুষ যে শহরে থাকে, সে শহর মানুষের জন্য কী করে অনিরাপদ হয়? আপাতত স্বস্তির সাথে বসলামবিমান আকাশে ডানা মেলার সাথে সাথে জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম দুবাই-উপকূলের কৃত্রিম দ্বীপে বানানো হোটেল আটলান্টিস ও পামজুমায়রা; ওপর থেকে অপরূপ লাগছিল! তারপর শুরু হলো বালুর সাগর পার হওয়ার পালাঘণ্টা দুয়েক পর গরম ভাপ ওঠা সুস্বাদু খাবারের গন্ধ ক্যাবিনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়লএমন খুশ্বুতে ক্ষিদে না লাগলেও খেতে ইচ্ছে করেখাবার আয়োজন চলছেএক ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিকেন অর ফিশ’? প্রশ্ন করলাম, হোয়াট কাইন্ড অব ফিশ? ‘হামুরহাসিমুখে বললেন তিনিসাধারণত সফরে আমি মাছ খাই না, কিন্তু কী মনে করে তখন বলে ফেললাম, লেট মি ট্রাই ফিশখেয়ে ভালোই লাগলহামুরঅত্যন্ত মজাদার একটি সামুদ্রিক মাছআপনারাও কোনো দিন সুযোগ পেলে খেয়ে দেখবেন

বিস্তীর্ণ মরুভূমির ওপর দিয়ে উড়ে এসে যখন বৈরুতে নামলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেলেও বিকেল হয়নিএরাইভ্যাল এরিয়াতে এসে দেখি এক ভদ্রলোক আমার নাম লেখা এক টুকরো কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেনকাছে যেতেই তিনি বুঝে গেলেন আমিই তার অতিথিআমাকে নিয়ে এসে উঠলেন তার গাড়িতেভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে কেন জানি আমার মনে একটু সন্দেহ জাগলসঠিক লোক না হলে তিনি আমার নাম জানবেন কী করে? আজ এই ফ্লাইটে আমি আসছি, সেটাই বা বুঝবেন কিভাবে? এসব তো যুক্তির কথাতাতে কী? ভয়ভীতি কি আর যুক্তি মানে? একটু থিতু হয়ে গাড়িতে বসার পর তার সাথে দুকথা বলে মনে হলো, তিনি এলএইউর কোনো শিক্ষক নন, ট্যাক্সিওয়ালা তো ননইতাহলে তিনি কে? ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেলআমি কি কোনো কিডন্যাপারের ফাঁদে পা দিলাম? তবে নার্ভাস না হয়ে একটু বুদ্ধি খাটালামতাকে বললাম, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? আমার এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য, যদি তিনি আমার হোটেলের নাম সঠিক বলতে পারেন, তাহলে আমি নিশ্চিত হবো যে, আমার ড্রাইভার এলএইউর পাঠানো ব্যক্তি এবং নিরাপদযখন বললেন, ‘কমোডর হোটেল’, তখন স্বস্তি পেলাম, ভয় কেটে গেলএদিক-ওদিক তাকিয়ে এককালের প্রাচ্যের ভেনিস, বৈরুতের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম

এর মধ্যে গাড়ি ভূমধ্যসাগরের পাড় ধরে চলতে শুরু করেছেরাস্তার দুধারে সারি সারি পামগাছকিন্তু বড় করুণ তাদের চাহনি! সব কটা গাছের ডাল ও পাতা আধমরা, শুকিয়ে বাদামি রঙ ধরেছে, নিচের দিকে সামান্য একটু সবুজের ছোঁয়া আছে মাত্রভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, গাছগুলোর অবস্থা এমন কেন? তিনি বললেন, ‘বৃষ্টি হচ্ছে না, তাইসাগরভরা পানি, অথচ পানিরই অভাবে পানিসংলগ্ন সাগরতীরের গাছগুলো সব মৃত্যুর সাথে লড়ছেহলে কী হবে, মনে হলো, তবু তারা মানুষের মতো অকৃতজ্ঞ নয়! আধমরা গাছগুলো একাগ্রচিত্তে তাদের প্রভুর নাম জপছে আর বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন গুনছে

একটু পরেই গাড়ি ডান দিকে বাঁক নিয়ে পুরনো বৈরুতের ভেতর ঢুকে পড়লচার দিকে জীর্ণশীর্ণ অতি প্রাচীন দালানকোঠা, ঘরবাড়িতে দারিদ্র্যের ছাপ প্রকট, চাপা চাপা রাস্তা, কোনোরকমে একটা গাড়ি চলতে পারেময়লা-নোংরা সরু গলি দিয়ে গাড়ি এলোমেলোভাবে ধীরগতিতে চলতে লাগলদিনের বেলাও অন্ধকার অন্ধকার লাগছে, আর বনের বাঘের আগে মনের বাঘে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে! ভয়-ভীতি যেন আমাকে ছেড়েও ছাড়ছে নাসাধারণত বাইরে গেলে আমি ড্রাইভারদের সাথে ফটর ফটর অনবরত কথা বলতে থাকি, কিন্তু সেদিন আমার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিল নাভয়ে কাঁপছি এবং আল্লাহ আল্লাহ করছি

এভাবে ঘুরেফিরে এক সময় গাড়ি এসে থামল হোটেল কমোডরের সামনেআপতত ভয়ের অবসান হলোজিনিসপত্র টেনে নিয়ে হোটেলে উঠলামবিকেলে খেতে যখন নিচে নামলাম, তখন ফের ভীতি এসে আমাকে তাড়া করতে লাগললবিতে দেখলাম লোকজন আছে, কথাবার্তাও বলছে, কিন্তু কেন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছেতার ওপর আরেকটা বিষয় নজর কাড়লযখন চেকইন করি তখন ক্লান্তি এবং তাড়াহুড়োর কারণে খেয়াল করিনি, এবার দেখলাম; দেখে একটু ঘাবড়ালামও বটে! পাঁচ তারকা হোটেল, তার সামনের প্রধান রিভলভিং ডোর বন্ধডান দিকের ছোট দরজা দিয়ে লোকজন ঢুকছে এবং বাঁ দিকেরটা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেডান দিকের দরজার পরেই এয়ারপোর্টের মতো একটি মেটাল ডিটেক্টর গেট, যার ভেতর দিয়ে আমি ঘণ্টাখানেক আগেই পাস করেছি, কিন্তু টের পাইনিআরো দেখলাম ওই সিকিউরিটি দরজার পাশে একটি টেবিলের ওপরে রাখা কালো মেটাল ডিটেক্টর বাটনকাছেই স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে একজন সিকিউরিটি গার্ডভয়ে ভয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের হোটেলে ইদানীং কি কোনো অঘটন ঘটেছে? বলল, ‘না, হোটেলে কিছু হয়নি, তবে শহরে এদিক-ওদিক যখন-তখন বোমাবাজি হয়, তাই আমরা সবসময় সাবধান থাকিহোটেলে এসেও শান্তি নেই! বুঝলাম বৈরুতের বাকি দিনগুলোও আমাকে এভাবেই কাটাতে হবে

এবার ভয়কে ঠেলে দিয়ে পেটের ধান্ধায় লাগলামখবর নিয়ে দেখলাম হোটেলে দুটো রেস্তোরাঁ আছে, একটা জাপানি আরেকটা লেবানিজহিরোশিমা-নাগাসাকির পর জাপানিরা আমেরিকাকে খুব সমীহ করে, কিন্তু বৈরুতের ভয় তাদের কাবু করতে পারেনিজীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুদূর ভূমধ্যসাগরের পাড়ে এসেছে ব্যবসা করতেজাপানি খেতে ইচ্ছে হলো না, তাই লেবানিজ রেস্তোরাঁয় গেলাম এবং মেন্যু না পড়ে কিচেন কাউন্টারে তৈরি খাবার দেখে দেখে রুম সার্ভিস অর্ডার করে ফিরে এলামআধা ঘণ্টার মধ্যে একটি বিশাল ট্রে হাতে করে ওয়েটার এসে রুমে হাজিরতৃপ্তির সাথে খুব মজা করে খেলামকতক্ষণ টিভি দেখে ঘুমোতে গেলামবালিশে মাথা রাখার সাথে সাথে অন্য ধরনের এক আজব শঙ্কা আমাকে ঘিরে ধরল

আপনাদের হয়তো মনে আছে, উনিশ শপঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতেরই এক হোটেলে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেনআমার বারবার ভয় হচ্ছিল, আমিও যদি এভাবে ঘুমের মধ্যে মরে পড়ে থাকি, তা হলে কী হবে? নিজের অবুঝ মনকে নিজেই বোঝাতে লাগলাম, সোহরাওয়ার্দী সাহেব একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আমি তো তার ব্যাগ বওয়ারও যোগ্য নইতিনি বৈরুতে এসে মারা গেছেন বলে আমিও মারা যাবো এটা কি কোনো যুক্তির কথা হতে পারে? অবশেষে মনের ভয় যুক্তির কাছে না হলেও ক্লান্তির কাছে হার মানলকখন যে কিভাবে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিলাম সেটা টেরই পাইনিসকালে উঠে দেখলাম ওই সব ভয়টয় উবে গেছেপ্রথম রাত যখন পার করে দিয়েছি, তখন এ যাত্রা আর মরব না

আগের কথামতো সকাল সাড়ে দশটায় এলএইউর দুজন শিক্ষক এলেন আমাকে নিয়ে যেতেআমরা ১৫-২০ মিনিট পথ হেঁটে ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেলামগেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবো, দেখি এক সৈনিক একে-৪৭ কাঁধে নিয়ে বসে আছেবাইরে যেমনই হোক না কেন, ক্যাম্পাসের ভেতরটা নিরাপদ, ছেলেমেয়েদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুরপ্রথমে ডিন ও পরে অর্থনীতি বিভাগের প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করলামলেবানিজদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের চেহারা দেখে কিংবা নাম শুনে বোঝা যায় না, কে মুসলমান এবং কে খ্রিষ্টানতাই কাকে সালাম করব আর কাকে গুডমর্নিং বলব সেটা ঠাহর করা কঠিন হয়ে দাঁড়ালবিভাগীয় প্রধান কথায় কথায় লেবানিজ সিভিল ওয়ারের কথা বললেনআমি বুঝলাম, তিনি মন খুলে আমার সাথে সব কথা বলতে পারেননি; হয়তো বা আমি মুসলমান বলেশুধু বললেন, ‘গরম যুদ্ধ শেষ হয়েছে ২৫ বছরেরও ওপরে, এখন ঠাণ্ডা লড়াইয়ের টানাপড়েনে লেবানন একটা ডিসফাংশনাল স্টেট হিসেবে চলছে১৯৭৫ থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে চলছে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষমারামারি শেষ হয়েছে, অথচ এখনো বৈরুতের রাস্তাঘাটে এবং দালানকোঠায় দেখা যায় যুদ্ধের জ্বলজ্যান্ত চিহ্নমানুষের সাথে কথা বলে বুঝলাম, তাদের হৃদয়ে রয়ে যাওয়া ক্ষত তার চেয়েও গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে

কেমন করে বুঝলাম, এবার শুনুন তার বয়ানলাঞ্চে যাওয়ার সময় বিভাগীয় প্রধানকে জিজ্ঞেস করলাম, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মুসলমান-খ্রিষ্টান অনুপাত কত? তার পাশ থেকে আরেকজন জবাব দিলেন, ‘আমরা এ পরিসংখ্যান রাখি নাএটা শুনে শিক্ষকদের মধ্যে অনুপাত কেমন, তা আমি আর জানতেও চাইনিলাঞ্চ সেরে এসে বসলাম অন্য এক অধ্যাপকের অফিসেতার নাম হোসেইন জিটারড. জিটারের সাথে কথা হচ্ছিল কাহ্লিল জিবরানকে নিয়েদেখলাম তিনি জিবরানের একজন বড় ভক্তকথা বলতে বলতে হোসেইন উঠে তার পেছনের দেয়াল থেকে একটা কাঠের ডেকোরেশন পিস নিয়ে এসে আমাকে গিফ্ট করলেনওর মধ্যে জিবরানের একটা স্কেচ পোট্রেটসহ আছে জিবরানেরই লেখা একটি আরবি কবিতাআমাকে কিছু পড়ে শোনালেনতিনি আমাকে পরদিন জিবরানের গ্রামের বাড়ি, মিউজিয়াম ও তার সমাধিতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেনডেকোরেশন পিসের সাথে তিনি একজোড়া তসবিহ নামালেনআমি জানতে চাইলাম, আপনি এগুলো দিয়ে কী করেন? তিনি বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ্, সুবহানাল্লাহ্ পড়িএবার আমি নিশ্চিত হলাম, তিনি মুসলমান

আমি নামাজ পড়তে চাইলাম, তিনি একটা টাওয়েল বিছিয়ে দিলেনতারপর মন খুলে আমার সাথে বেশ কিছু কথা বললেন, মনের দুঃখ নামাতে পেরে মনটাকে হালকা করলেনবললেন, এলএইউতে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ৭০ শতাংশের মতোপ্রতিষ্ঠানটির সমানুপাতিক আয় আসে মুসলমান অভিভাবকদের কাছ থেকে, অথচ শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ২০ শতাংশ মুসলমানও নেইযাওবা আছে, তারা পদে পদে দারুণভাবে বৈষম্যের শিকারসব রিকোয়ারমেন্ট মিট করার পরও আমার প্রমোশন হয়নিএকমাত্র কারণ, আমি মুসলমানবুঝলাম, প্রশাসন খ্রিষ্টানদের দখলেসাধ্যমতো তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলামবললাম, আপনাদের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা আমারও আছে‘Life is not fair, but still it is good!’তা না হলে তো মানবের জন্য দড়ি-কলসি জোগান দেয়াই কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াত

আলোচনার একপর্যায়ে জিবরান সম্পর্কে তার কাছে আমি একটি প্রশ্ন রাখলামমুস্তাফা, ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহম্মদ ছল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরই আরেক নাম, এ কথা জিবরানের অজানা ছিল নাতারপরও একজন খাঁটি খ্রিষ্টান হয়ে তিনি কেন তার মাস্টার পিস, ‘দি প্রফেট’-এর মূল চরিত্রের নাম আল-মুস্তাফা দিলেন? হোসেইন বললেন, খ্রিষ্টান হলেও জিবরান আমাদের রাসূল মুহম্মদ ছল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল এবং ঐতিহাসিকভাবে বিবদমান এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি সচেতনভাবে তার মাস্টার পিসের প্রধান ও মূল চরিত্রের নাম দিয়েছেন আল-মুস্তাফা

তারপর শুরু হলো আমার প্রেজেন্টেশনের পালাপ্রথমটা ছিল শিক্ষকদের জন্য, পরেরটা ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশেআমার সেমিনারে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতোএকটি বড় অডিটোরিয়াম, প্রায় ভরা ছিলছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা দেখলাম অনেক বেশিলেবানিজ মেয়েরা যে এত রূপবতী হয়, তা আমার জানা ছিল নাএকজনের চেয়ে আরেকজন সুন্দর একেকটি মেয়ে যেন বাগানের একেকটি প্রস্ফুটিত তাজা গোলাপশুধু রূপ নয়, গুণও আছে তাদেরবুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করেছে আমাকেআমেরিকার অর্থনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে যা যা জানতে চেয়েছে, তাতে মনে হলো তারা দিন-দুনিয়ার খোঁজখবরও রাখে এবং ভালোই রাখে

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানাদি শেষে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবার ফিরে আসার পালাবিকেল পাঁচটার সময় দুজন শিক্ষক আমাকে গাড়িতে করে হোটেলে নামিয়ে দিলেনযাওয়ার সময় বলে গেলেন, আটটায় এসে ডিনারে নিয়ে যাবেনডিনারে কোথায় গেলাম, কী খেলাম, কী আড্ডা মারলাম? তারপর রাতের বৈরুতে হেঁটে ও গাড়িতে করে কী কী দেখলাম, কী বুঝলাম, কী ভাবলাম, সেসব নিয়ে আরেকটা পিস লেখার ইচ্ছে আছেলিখতে পারলে অবশ্যই আপনাদের সাথে শেয়ার করবআজকের মতো এখানেই ইতি

অধ্যাপক : টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর: জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ;


শেয়ার করুন

0 facebook: