23 May 2018

চীনে ৯ লাখ মুসলিমদের বন্দি করে ‘ব্রেনওয়াশ’


আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ চীনে দুই কোটি মুসলিমের বাস৷ ইসলামি চরমপন্থা কমাতে মুসলমানদের ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে চীনের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করার জন্য খোলা হয়েছে বন্দিশিবির৷ অন্তত ৯ লাখ মানুষকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ৷

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে চীনে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ বেড়ে গেছে৷ কট্টরপন্থী উইগুর মুসলমানদের হামলায় গত কয়েক বছরে মারা গেছেন কয়েকশ মানুষ৷ এ কারণেই উইগুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আটক করে তাদের মতাদর্শ পরিবর্তনের জন্য বন্দিশিবির খোলা হয়েছে৷

যেসব শিবিরে মুসলমানদের রাখা হচ্ছে, সেটিকে বলা হচ্ছে ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্পবা দীক্ষাদান শিবির, যদিও এটি মুসলমানদের কাছে ব্রেনওয়াশকেন্দ্র হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ বন্দিশিবিরের একজন ওমির বেকালি৷ তিনি নিজের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন সংবাদ সংস্থা এপির কাছে৷

কয়েক বছর আগে চীন থেকে কাজাখস্তানে চলে গিয়েছিলেন বেকালি৷ ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চীনে আসেন৷ আসার পরই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেকালি সেই বন্দিশিবিরে তার ওপর চলা অসহ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন৷

বেকালি জানান, আটকের এক সপ্তাহ পর তাকে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাবার বা পানি দেয়া হয়নি৷ যখন তিনি তাদের নির্দেশ মানতেন না, তখন দেয়ালের সামনে ৫ ঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো৷ তখন টানা ২০ দিন ধরে তার ওপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তার পর তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন৷

বেকালি জানান, এই বন্দিশিবিরে যারা থাকেন, তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তা পরিবর্তন করতে হয়৷ নিজেদের সম্প্রদায়কে ত্যাগের কথা ভাবতে বাধ্য করা হয়৷ মুসলমান ছাড়াও এ শিবিরে বিদেশি কয়েকজনকেও রাখা হয়েছে৷ বন্দিশিবিরটিতে যারা নির্দেশক ছিলেন, তারা কট্টরপন্থী এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর দৃষ্টান্ত দিয়ে ইসলামের খারাপ দিকএবং ইসলামের কী কী ঝুঁকি রয়েছে, তা বলতেন৷

বেকালির ভাষায়, এটি একটি অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, ‘কেননা আমি নিজের ভাবনার সমালোচনা করছি, নিজের সম্প্রদায়কে অস্বীকার করার কথা ভাবছি৷গত বছরের ডিসেম্বরে বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পান তিনি৷ কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়৷

তিনি জানান, বন্দিশিবিরে সবাইকে খুব ভোরে উঠতে হতো৷ চীনের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো৷ সকাল সাড়ে ৭টায় চীনের পতাকা উত্তোলন করতে হতো৷ এ ছাড়া এমন সব গান গাওয়া হতো যেগুলোতে কেবল কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা করা হয়েছে৷ এ ছাড়া তাদের চীনা ভাষা এবং চীনের ইতিহাস পড়তে হতো৷

বেকালি জানান, খাবার হিসেবে প্রতিদিন সবজির স্যুপ আর রুটি দেয়া হতো৷ মাঝে মাঝে শুকরের মাংস এবং মদ খেতে বাধ্য করা হতো৷ তবে খাওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে ধন্যবাদ জানাতে হতো, পাশাপাশি মাতৃভূমি এবং চীনা রাষ্ট্রপতিকেও ধন্যবাদ জানাতে হতো৷

চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং এলাকায় এই বন্দিশিবিরগুলো স্থাপনের লক্ষ হলে মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনা৷ তাদের নিজেদের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা পুরোপুরি দূর করা এবং তাদের নতুন রূপে পরিচয় করানো৷ জিনজিয়াংয়ের থেকে নির্বাসিত মানুষদের দ্বারা পরিচালিত তুরস্কভিত্তিক একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে বেশ কিছু ফাঁস হওয়া সরকারি তথ্য রয়েছে, যার মাধ্যমে জানা গেছে- এসব বন্দিশিবিরে ৯ লাখ মানুষ বন্দি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার মতে, সংখ্যালঘুদের এত বিশাল গণকারাগার বিশ্বে আর কোথাও নেই৷

চীনা কর্তৃপক্ষ এ বন্দিশিবিরের কথা স্বীকার করে না৷ তবে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়তে মতাদর্শ পরিবর্তন করা দরকার৷ সংবাদ সংস্থা এপি বন্দিশিবিরের বেশ কয়েকজন বন্দি এবং নির্দেশকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ প্রত্যেকেই নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেনকেননা তাদের পরিবার রয়েছে চীনে৷

বেকালি কাজাখস্তান ফিরে গেছেন৷ ভেবেছিলেন কারো কাছে কিছু বলবেন না৷ কিন্তু গত মার্চে চীনা কর্তৃপক্ষ তার বাবা-মা এবং বোনকে ধরে নিয়ে যায়৷ তাই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্বকে তার গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেন৷ বেকালি জানান, তিনি এসব কথা জানাতে চানকারণ তার আর হারানোর কিছু নেই৷


শেয়ার করুন

0 facebook: