06 June 2018

মাওলা বা মাওলানা বলে আলেমদের ডাকা কি শিরক?



মুফতি আবদুল কাদির মাসুমঃ মাওলানাশব্দটি মাওলানাদুই আরবি শব্দের সমাসনাঅর্থ আমরা বা আমাদেরআর মাওলাশব্দের প্রায় ৩০ টি অর্থ রয়েছেযেমন: প্রভু,বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, দাস, চাচাতো ভাই, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নিকটবর্তী, আত্মীয়, নেতা, গুরু, প্রতিপালক, সর্দারপ্রেমিক, প্রতিবেশী, আনুগত্য, প্রার্থনা, নিরবতা, ইবাদত ও দন্ডায়মান ইত্যাদি

(সূত্র:-ইমাম ইবনুল কায়্যিমকৃত বাদায়িউল ফাওয়ায়িদ৪/৯৭৮, হযরত থানভীকৃত ফাতাওয়ায়ে আশরাফিয়াপৃঃ ৭০, বাবুল ফিকহ, ফতওয়া নং-৩১, হযরত লাখনভীকৃত উমদাতুর রিআয়াহ২/৩২৮, লিছানুল আরব ৮/৪৫২,ছিহাহ পৃঃ৮২০,কামুস ২/ ৬২৩, আলমিসবাহুলমুনীর পৃঃ৫৯১, মাকায়িছুল্লুগাহ ২/৫৪৯)
কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে মাওলাশব্দটি ব্যবহার হয়েছেআমাদের কিছু সংখ্যক লামাযহাবী ভাইয়েরা সঠিক অনুসন্ধান না করে বাহ্যিক দৃষ্টিতে বলে ফেলেন মাওলানাশব্দটি আল্লাহর সাথে সুনির্দিষ্টযেমন কুরআনে এসেছে- আনতা মাওলানা ফানছুরনা’ (সুরা বাকারাঃ২৮৬)এই আয়াতে মাওলানাবলে আল্লাহকে সম্বোধন করা হয়েছেবুঝা গেল এটি আল্লাহর বিশেষ্যসুতরাং কোন মানুষকে মাওলানাবলে সম্বোধন বা বিশেষিত করা জায়েয নয়; বরং শিরক

আমাদের ভাইদের এ বক্তব্যটি ঠিক নয়কেননা আল্লাহর ক্ষেত্রে মাওলানাশব্দকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে আলেমদের ক্ষেত্রে সে অর্থে ব্যবহার করা হয়নিআল্লাহর ক্ষেত্রে মাওলানাঅর্থ হল আমাদের প্রভু আর আলেমদের ক্ষেত্রে তার অর্থ হচ্ছে আমাদের (ধর্মীয়) অভিভাবক

(সূত্র:-কিতাবুল ফাতাওয়া ১/২২৮, কিতাবুল ইলম, ফতওয়া নং-১৫৩, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল ২/৬৩৮ মুতাফাররিক মাসায়েল)

ধরুন ভালোবাসাশব্দটিআপনি বললেন- আমি আমার বোনকে ভালোবাসিএবং বললেন- আমি আমার স্ত্রীকেও ভালোবাসিবলুনতো, স্ত্রীর ভালোবাসা ও বোনের ভালোবাসা উভয়টার মর্ম কি এক? কখোনো নাউভয়টার মর্ম ও অর্থের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎস্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা জৈবিকপ্রসূত আর বোনের প্রতি ভালোবাসা রক্তের বন্ধনের আকর্ষণপ্রসূততো ভালোবাসাশব্দটা যেভাবে দুই ক্ষেত্রে দুই অর্থে দুই মর্মে, অনুরুপভাবে মাওলানাশব্দটাও দুই ক্ষেত্রে দুই অর্থে ভিন্ন ভিন্ন মর্মে

মোটকথা আলেমদের ক্ষেত্রে মাওলানাশব্দের অর্থ হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় নেতা বা অভিভাবকআল্লাহর ক্ষেত্রে অর্থ হচ্ছে আমাদের প্রভু বা মালিক

যদি শুধু শব্দগত রূপ মিল থাকাতেই কোন শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমি বলবো-আমাদেরকে মুমিননামে আখ্যায়িত করা বা সম্বোধন করাও নাজায়েজকারণ আল্লাহ তাআলার ৯৯ নামসমুহের একটি হচ্ছে মুমিনঅথচ কুরআন ও হাদিসে জাগায় জাগায় মুসলমানদের মুমিনবলে বিশেষিত করা হয়েছেতো এখানেও কিন্তু বান্দার ক্ষেত্রে মুমিনশব্দের এক অর্থ আর আল্লাহর ক্ষেত্রে আরেক অর্থ, একইভাবে মাওলানাশব্দটার বেলায়ও ব্যাপারটা তাই

ইতিহাস তালাশ করলে আমরা দেখতে পাই, সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেয়ী হযরত হাছান বছরীকে লোকেরা মাওলানাবলে ডাকতো। (সূত্র:- তাহযীবুততাহযীব ২/২৬৩, আলবেদায়া ওয়ান্নেহায়া ৬/২৬৬)

রাসুল সা. হযরত যায়েদ বিন ছাবিত রা: কে বলেছেন, : « ﺃﻧﺖ ﺃﺧﻮﻧﺎ ﻭﻣﻮﻻﻧﺎ …ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ

হযরত আলী রাযি. তার ছেলে হযরত হাসান রা.র উস্তাদ আসলে হাসান রা.কে বলেছিলেন-
ﻗﻢ ﺑﻴﻦ ﻳﺪﻯ ﻣﻮﻻﻙ

অর্থাৎ তুমি তোমার মাওলার সামনে দাড়াও’ (সূত্র:-ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী ৫/৪৩৫)
ফাতাওয়ায়ে আলমগীরীর ভাষ্য এরুপ- ﻟﻮ ﻗﺎﻝ ﻷﺳﺘﺎﺫﻩﻣﻮﻻﻧﺎ ﺑﺄﺱ ﺑﻪ ﻗﺪ ﻗﺎﻝ ﻋﻠﻰ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻻﺑﻨﻪ ﺍﻟﺤﺴﻦ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ : ‘ ﻗﻢ ﺑﻴﻦ ﻳﺪﻯ ﻣﻮﻻﻙ، ﻋﻨﻰ ﺃﺳﺘﺎﺫﻩ ﻛﺬﺍ ﺑﺄﺱ ﺑﻪ ﺇﺫﺍ ﻗﺎﻝ ﻟﻤﻦ ﻫﻮ ﺃﻓﻀﻞ ﻣﻨﻪ
( ﺍﻟﻔﺘﺎﻭﻯ ﺍﻟﻌﺎﻟﻤﻐﻴﺮﻳﺔ ٤٣٥ / ٥ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﻜﺮﺍﻫﻴﺔ، ﺍﻟﺒﺎﺏ ﺍﻟﺜﻼﺛﻮﻥ ﻓﻰ ﺍﻟﻤﺘﻔﺮﻗﺎﺕ )

তাছাড়া আরেকটা লক্ষণীয় বিষয়, উর্দূ ভাষায় মাওলানাশব্দটি উস্তাদ ও আলেমে দীন অর্থেও ব্যবহৃত হয়
(দেখুন- রহমাতুল্লাহ জালালাবাদী রহ. কৃত আলহাদিয়্যাতুল মারযিয়্যা পৃঃ ১১৭ , ফিরুজুল্লুগাত পৃঃ ৬৬৪)

আমরা যেহেতু এই শব্দের ব্যবহার উর্দুভাষীদের থেকে পেয়েছি, তাই মাওলানা দ্বারা এই দুই অর্থই উদ্দেশ্যআর হযরত আলীর উক্তি থেকেও এই কথাই বুঝা যায়


শেয়ার করুন

0 facebook: