12 January 2019

বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মুছেই যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য


হাসান মুহম্মদঃ আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগে নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে মানুষের প্রতিটি কাজ হচ্ছে সহজ থেকে সহজতরবিদ্যা-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রচালিত শক্তি ব্যবহারে স্বল্প খরচ ও স্বল্প সময়ে অধিক কাজ সমাধান করা ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছেযন্ত্রচালিত শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাম বাংলার অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যই আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেহারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ হওয়ায় উল্লেখ্যযোগ্য কিছু বিষয় নিয়ে এই আয়োজন

হালচাষ
কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হালচাষ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কাকডাকা ভোরে কৃষকরা লাঙ্গল কাঁধে এক জোড়া গরু/মহিষ নিয়ে বেরিয়ে যেত মাঠের জমিতে হালচাষ করার জন্য। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে কৃষকের লাঙ্গল দিয়ে হালচাষসঙ্গে ভাটিয়ালি-পল্লীগীতি গানের মধুর সুর মাতিয়ে রাখতো হাট-ঘাট ও মাঠ। কৃষাণীরা সাজিয়ে নিয়ে যেতেন সকালের নাস্তা পিয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তাভাত ও দুপুরে গরম ভাত। এটাই ছিল গ্রামবাংলার কৃষাণ-কৃষাণীর চিরাচরিত অভূতপূর্ব দৃশ্য। এখন এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে না বললেই চলে। দিন বদলাচ্ছেবদলাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে পাল্টে যাচ্ছে সব কিছুই। আধুনিকতার স্পর্শে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনেও এসেছে নানা পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়াও লেগেছে কৃষিতে। তাইতো কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে এসেছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙ্গল-জোয়াল। চিরায়ত বাংলার রূপের সন্ধান করতে গেলে এই দুই কৃষি উপকরণের কথা যেমন অবশ্যই আসবেতেমনি আসবে হালের গরুর কথাও

খেজুরের রস
শীতের মৌসুমে সকালে রসের হাড়ি ও খেজুরগাছ কাটার সরঞ্জামসহ গাছির ব্যস্ততার দৃশ্য চোখে পড়তসকালে খেজুরের রস নিয়ে গাছিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে রস বিক্রি করত। মৌসুম শুরু হতেই বাড়ি বাড়ি চলত খেজুরের রস কিংবা রসের পাটালি গুড় দিয়ে মজাদার পিঠাপুলির আয়োজনআর খেজুরের রস দিয়ে তৈরি ঝোলা গুড়ের সুনাম তো ছিলইতবে গ্রামবাংলার এই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এর প্রধান কারণ ইটের ভাটায় ব্যাপকভাবে খেজুরগাছ ব্যবহার করায় এই গাছ কমে যাচ্ছেখেজুরগাছ সস্তা হওয়ায় ইটের ভাটায় এই গাছই বেশি পোড়ানো হয়খেজুরগাছের ব্যাপক নিধনের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো শরীয়তপুরের ডামুড্যাসহ আশপাশের উপজেলার কমছে খেজুরগাছদুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে খেজুরের রস। তবে এখনও কিছু খেজুরগাছ থাকলেও গাছির সংকটে এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যাচ্ছে নাকয়েক গ্রামের ব্যবধানে দুএকজন গাছি পাওয়া গেলেও গাছ তুলনামূলক কম থাকায় রস সংগ্রহের কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে নাফলে খেজুরের রসের দাম আকাশছোঁয়াসুস্বাদু এই প্রাকৃতিক মধু খেজুরের রসের স্বাদ নিতে দুইশ টাকা কেজি দরেও পর্যাপ্ত রস কিনে পরিবারের লোকজন নিয়ে খেতে পারছে নাফলে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী শীতের খেজুর রসের ক্ষীর পুলি পিঠা, রসের মা-মিঠাইসহ নানা মুখরোচক খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম

পালকি
চিরায়ত গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ধারক পালকি আর চোখে পড়ছে নাপালকিও কোন কোন খানদানি বাড়িতে অচল হয়ে পড়ে আছেকিংবা মিউজিয়াম পিস হয়ে কালের স্থানু সাক্ষী হয়ে আছে জাদুঘরেসুর করে গান গেয়ে সেই কিনু গোয়ালার গলি ঘুরে মাঠ প্রান্তর পেরিয়ে গন্তব্যের কাছে দূর থেকে ছয় বেহারাদের আর দেখা যাচ্ছে নাতাদের ছন্দ-লয়ে হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে এ গাঁও থেকে ওগাঁয়ে নাইয়র, বিয়ের কনে-বর কিংবা মান্যগণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়ার এ চক্রবিহীন যান সম্ভবত তার অন্তিম প্রহর গুনছে। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, হেমন্তের গানে কিংবা ভূপেন হাজারিকার মাদল মাদক তানে চলা পালকি এখন ঐতিহ্যের খাতায় নাম লেখাচ্ছেসেই ন্যাংটা পুঁটো ছেলেটা আর বলে না পালকি চলে, পালকি চলেঃ আদুল গায়ে যাচ্ছে কারা -যাচ্ছে কারা হনহনিয়ে। পালকি বহরের আর সেই পরিচিত দৃশ্য এখন আর দেখা যায় নাআধুনিক যোগাযোগের গোগ্রাসে পালকি হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতল তলে প্রাচীন বাংলার এ বাহনটি

ঢেঁকি
ভোর সকালে গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে কৃষানীদের নবান্নের ছেড়াকুটা আর পিঠা তৈরির চালের গুঁড়া করার ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ যেন কোথায় হারিয়ে গেছেও ধানু ধান বানোরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, আমি নাচি তুমি নাচ হেলিয়া দুলিয়া ও ধান বানোরে’ গ্রামের গৃহস্থ বাড়ির বৌঝিদের একসঙ্গে ধান বানার সেই ঐতিহাসিক গীত এখন আর শোনা যায় না। এক সময় গ্রামগঞ্জের গৃহস্থ বাড়িতে ধান বানার জন্য ঢেঁকি ছিল গৃহস্থালি কাজে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বস্তুকিন্তু এখন আর সে সকল বাড়িতে ঢেঁকি নেইগৃহস্থরা কেউ পুরনো ঢেঁকিকে জঞ্জাল মনে করে তা চিরে কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেছেআবার কেউ নিদর্শন হিসেবে বৈঠক ঘরের সিলিংয়ে রেখে দিয়েছেফলে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্পএ অঞ্চলের ভূমিহীন, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা অভাবী অসহায় মহিলাদের আয় উপার্জনের প্রধান উৎস ছিল ঢেঁকি দিয়ে ধান বানা অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষায় তারা ছিল বারানী শ্রমজীবী

ঢেঁকির ছাঁটা ধানের চালের ভাত খেতে সুস্বাদু এবং ঢেঁকির চালের গুড়া দিয়ে পিঠা বানালে এর স্বাদ আরো অতুলনীয়এখন প্রতি গৃহস্থ বাড়িতে সকাল সন্ধ্যায় ঢেঁকির একটানা চিরচেনা ধুপধাপ মিষ্টি শব্দের পরিবর্তে ধান ভাঙ্গানোর শ্যালো মেশিনের কান ঝালাপালা করা শব্দদূষণ সকল কাজে বিঘœ ঘটাচ্ছেসকালে কৃষানীর ঢেঁকি বানার শব্দে যে কৃষকের ঘুম ভাঙতো সেই কৃষক শ্যালো মেশিনের বিকট শব্দে এখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেতাই সব মিলিয়ে আজ যান্ত্রিকতার চাপে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিশিল্প ক্রমান্বয়ে বিলীনের পথে

তেলের ঘানি
তেলের ঘানি বিলুপ্তপ্রায়কুলু সম্প্রদায় আজ আর তেমন নেইঘানিতে তেল উৎপাদনকারীকে স্থানীয়ভাবে কুলু ও সাজি বলা হয়ে থাকেসময়ের বিবর্তন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা পেশা বদল করেছেতাই চোখে পড়ে না কুলুর ঘানিওএক সময় নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার প্রায় গ্রামেই কুলু সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতোতাদের পেশাই ছিল সরিষা থেকে তেল উৎপাদন করা এবং গ্রামে গ্রামে ফেরি করে তা বিক্রি করাঘানি দিয়ে তেল উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রত্যন্ত এলাকাতেও তেলকলের প্রচলন হওয়ায় কমে যাচ্ছে কুলুদের কদর। আধুনিক মেশিনে উৎপাদিত সরিষার তেলে এখন বাজার সয়লাবতাই শত শত কুলু পরিবার তাদের ঘানি বন্ধ করে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেমহাদেবপুর উপজেলায় একসময় ছয়-সাত শতাধিক কুলু পরিবার বাস করতএসব পরিবারের লোকজন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা কিনে বাড়িতে ঘানি টেনে তৈরি করত খাঁটি সরিষার তেলসময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এখন আর গরুর ঘানি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর


আরও রয়েছে কুটির শিল্প, গ্রামবাংলার লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, ঐতিহ্যবাহী হুক্কা, হারিকেন, স্বচ্ছ পানির কুয়া, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, মৃৎশিল্প, নিদর মাটির ঘর, জাতা, বাঁশের তৈরি কারুশিল্প ইত্যাদি


শেয়ার করুন

0 facebook: