18 April 2018

কে ছিলেন এই গোপাল ভাঁড় ?


স্বদেশবার্তা ডেস্কঃ মিষ্টির দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে সন্দেশ, পানতোয়া, রসগোল্লাসহ হরেক মিষ্টান্নএমন রসাল মিঠাই দেখে কার না জিবে জল আসে! ছোট্ট গোপালেরও এলমামাবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন তিনিপথিমধ্যে দোকানে মিষ্টি দেখে জিবে জল আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খিদেও গেল বেড়েপেটে যেন শুরু হলো ছুঁচোর কেত্তনকিন্তু হাতে কোনো টাকাপয়সা নেইকী করা যায়? গোপাল দেখলেন, দোকানে বসে আছে ময়রার ছেলেআর তার বাবা দুপুরের খাবার খাচ্ছে পেছনের ঘরে বসেঅমনি থালায় সাজানো মিষ্টি টপাটপ করে খেতে শুরু করলেন তিনিআকস্মিক এই কাণ্ডে ময়রার ছেলে তো অবাককে রে তুই? বলা নেই, কওয়া নেই, দিব্যি মিষ্টি খেয়ে চলেছিস? কী নাম তোর?’ বলল সেএকের পর এক মিষ্টি পেটে চালান দিতে দিতেই গোপালের জবাব, ‘আমার নাম মাছিআমি তো রোজই মিষ্টি খাইতুই কি নতুন দেখলি আমাকে?’

ছেলেটি এরপর তার বাবাকে ডেকে বলল, ‘বাবা, মাছি মিষ্টি খাচ্ছেবাবা বলল, ‘খাগগেও আর কত মিষ্টি খাবেরোজই তো খাচ্ছেতুই কোনো দিন ওকে আটকাতে পারবি না

শেষমেশ ছেলে আর কী করে! চুপ হয়ে গেলগোপাল ততক্ষণে দোকানের সন্দেশগুলো শেষ করে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বাড়ির পথ ধরেছেন

ঢোল-শোহরত করে কাউকে আর বলে দেওয়ার দরকার নেই, ওপরের গল্পটি গোপাল ভাঁড়েরযিনি ভাঁড়, আমাদের কাছে তিনিই তো গোপালভাঁড়ের অবয়ব মনে এলে তাই অবধারিতভাবে টাকমাথায় টিকিওয়ালা পেট মোটা দারুণ এক রগুড়ে লোকের চেহারাই ভেসে ওঠে বাঙালির চোখেতাঁর নাম অবশ্যই গোপাল ভাঁড়কালপরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত তাঁর গল্প শুনে হাসেনি এমন গোমড়ামুখো বাঙালের দেখা পেতে গেলে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো ঘটনা ঘটবেকেননা, এখন অব্দি গোপাল ভাঁড়ই রসপ্রিয় বাঙালির মৌখিক ঐতিহ্যের যথাযোগ্য প্রতিনিধিলোকমুখে পল্লবিত তাঁর গল্পগুলোতে চমৎকার হাসির রেখা আছে বটে, তবে ওই হাসির নেপথ্যে গুপ্তঘাতকের মতো রয়েছে মিছরির ছুরিও এক সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে সমালোচনার মাধ্যমে কেটে উদোম করে দেয় সেই ছুরিআছে লোকশিক্ষা, নীতিশিক্ষা ও মোটাদাগে সমাজসংস্কারের ব্যাপার-স্যাপারএত কিছুর পরও গোপাল বাঙালির কাছে ভাঁড় বই বেশি কিছু নয়, হাস্যরসিক এক কৌতুকপ্রিয় চরিত্রতার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এর মধ্যেই নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও অ্যানিমেশন ছবিএ ছাড়া কে না জানে, উনিশ শতকের শুরুতে সদ্য গঠিত নগর কলকাতায় বিপুল পসার জমানো বটতলাকেন্দ্রিক সাহিত্যের অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই গোপাল ভাঁড়ের গালগল্প

আজকের বাংলাদেশে গোপাল ভাঁড়ের জয়জয়কার আগের মতো নেইতার পেছনে সামাজিক কিছু কারণ নিশ্চয়ই আছেপাশাপাশি এ-ও ঠিক যে বাঙালির হৃদয় থেকে হাস্যরসিক এই চরিত্রটিকে মুছে দেওয়া অত সহজ নয়কেননা, কালে কালে গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে গঙ্গা-পদ্মা-যমুনায় কম জল ঘোলা হয়নিগোপাল ভাঁড় কে? আদতেই কি এই নামে কেউ ছিল? নাকি গোপাল একাধিকজনের সমষ্টি?

কেউ বলেছেন, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে বাস্তবেই ছিলেন তিনিকারও কারও কথা, গোপাল ভাঁড় নামে একক কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব খোঁজা বৃথাকারণ, ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না

গোপালের অস্তিত্বের পক্ষে-বিপক্ষের এসব প্রশ্নে যাঁরা জোর তর্ক-বিতর্ক করেছেন, সবাই বিদগ্ধজনফলে জল ক্রমাগত ঘোলাই হয়েছেসেই তুলনায় বিশিষ্টদের পাশে আমরা বরং অবশিষ্টমাত্রঅবশিষ্টরা অনেক অকাজের ওস্তাদসঙ্গতকারণে গোপাল ভাঁড় ছিলেন কি নেইপ্রশ্নের তদন্তে ইতিহাসের ঘোলা জলে আরেকবার সাঁতার দেওয়া যাকতাতে হয়তো পানি আরেকটু অধিক ঘোলা হবে, এর বেশি কিছু নয়

বাঙালের গোপাল ভাঁড়-দর্শন

নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দরবারতাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (কৃষ্ণচন্দ্রই ভারতচন্দ্রকে রায়গুণাকর উপাধি দিয়েছিলেন) অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিদ্যাসুন্দরঅংশ লিখে শেষ করেছেনএখন সেটি পড়া হচ্ছেরচনাটি দুহাতে ধরে পাঠ করছেন স্বয়ং ভারতচন্দ্রএমন সময় দরবারে প্রবেশ করলেন গোপাল এবং কেউ কিছু বলার আগেই ভারতচন্দ্রকে উদ্দেশ করে হইহই করে উঠলেন তিনি, ‘ও হে কবিমশায়, করছেনটা কী, খাতাটা অমন কাত করে রেখেছেন কেন? রস যে গড়িয়ে পড়বে!

উজ্জ্বলকুমার দাস সংকলিত গোপাল ভাঁড়ের সেরা ১০০ গল্প বইয়ে স্থান পাওয়া এই গল্পটি অবশ্যই রসে টইটম্বুর, তবে এখানে গোপালের তত্ত্ব-তালাশের প্রাথমিক একটি সূত্র হাজির আছেসূত্রটি হলো কৃষ্ণচন্দ্র

বাংলা অঞ্চলের প্রবল প্রতাপশালী চরিত্র নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০-৮৩) রাজত্বকাল ৫৫ বছরের১৮ বছর বয়সে তিনি যখন সিংহাসনে বসেন, তখন ১৭২৮ সালশাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও শিল্প-সাহিত্যানুরাগীযদিও ১৭৫৭-তে পলাশীর প্রেক্ষাপটে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের দায়ে ইতিহাসে তিনি বেইমানহিসেবে চিহ্নিত, তবু এতে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের কাহিনি মুছে যায় নাতাঁর সভাসদ ছিলেন মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ

এই কৃষ্ণচন্দ্রের সভার অনেক রত্নের এক রত্ন ছিলেন গোপাল ভাঁড়এমন বক্তব্য পণ্ডিতদেরএ বিষয়ে তাঁরা স্থির সিদ্ধান্তে না এলেও এই মতের পক্ষেই রয়েছে অধিকাংশের সায়যেমন বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা বইয়ে অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গোপাল রসিক-চূড়ামণি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন

১৯৫২ সালে হোমশিখা পত্রিকা গোপাল ভাঁড়ের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেগোপাল ভাঁড়কে নিয়ে নতুনভাবে বোঝাপড়াই ছিল পত্রিকাটির উদ্দেশ্যসেখানে গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচলিত গল্পসংগ্রহনামের প্রবন্ধে অধ্যাপক মদনমোহন গোস্বামী লেখেন একই কথা, ‘শোনা যায়, মহারাজের (রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের) সভায় আরেকটি রত্ন ছিলেনতিনি স্বনামখ্যাত রসসাগর গোপাল ভাঁড়

তাহলে কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের সময় থেকে আমাদের এই সময়ের দূরত্ব ১৭০০ থেকে ২০০০৩০০ বছরেরকিন্তু মাত্র ৩০০ বছরের আগেকার মানুষ গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে এত ধোঁয়াশা থাকবে কেন, যেখানে তাঁর সমসাময়িক কৃষ্ণচন্দ্র, ভারতচন্দ্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব নেই? এর কারণ, একেক মুনির একেক মত

সুকুমার সেন, পরিমল গোস্বামী, অতুল সুর কি অজিতকৃষ্ণ বসু প্রমুখ পণ্ডিত গোপাল ভাঁড়ের বিভিন্ন প্রসঙ্গে যখন দ্বিধাবিভক্ত, তখন ১৯২৬-এ (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) বঙ্গভূমিতে মৃদু কম্পন জাগাল নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড় নামের একটি পুস্তকলেখক শ্রীনগেন্দ্রনাথ দাসতিনি নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর দাবি করলেনশুধু কি দাবি? তাঁর বক্তব্যে প্রথমবারের মতো সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হলেন গোপাল ভাঁড়আগে কেউ কেউ গোপালের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাঁর বংশের ঠিকুজি মেলে ধরতে পারেননিনগেন্দ্রনাথের মতে, গোপালের প্রকৃত নাম গোপাল চন্দ্র নাইতিনি ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ অন্তঃপুরের ভান্ডারের তত্ত্বাবধায়কতাই গোপাল চন্দ্র নাই থেকে তাঁর পদবি হয়ে গেল ভান্ডারিভান্ডারি থেকে আরও পরে ভাঁড়তাঁর বাবার নাম দুলাল চন্দ্র নাইপ্রপিতা আনন্দরাম নাইজাতিতে তাঁরা নাপিততবে দুলাল চন্দ্র ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁর শল্যচিকিৎসক বা বৈদ্যতৎকালে অস্ত্র-চিকিৎসা নাপিত জাতির অধিকৃত ছিলমন্তব্য করে নগেন্দ্রনাথ দাস নবদ্বীপ কাহিনীতে তথ্য দিয়েছেন, গোপালরা ছিলেন দুই ভাইবড় ভাই কল্যাণ আর ছোট ভাই গোপালতাঁর জন্ম অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি, মুর্শিদাবাদেনগেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় গোপালের গুণে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরে লইয়া যানগোপাল অতি সুপুরুষ ও বাল্যকাল হইতে সুচতুর ও হাস্যোদ্দীপক বাক্যাবলী প্রয়োগে বিশেষ পটু ছিলেনমহারাজ বিক্রমাদিত্যের ন্যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের একটি পঞ্চরত্নের সভা ছিলমহারাজ কৃষ্ণ গোপালের প্রত্যুৎপন্নমতি ও বাকপটুতা দেখিয়া তাঁহাকে স্বীয় সভায় অন্যতম সদস্য পদে নিযুক্ত করেন।...গোপালের একটি পুত্র ও রাধারাণী নামে একটি কন্যা ছিলরাধারাণীর দুই পুত্র রমেশ ও উমেশবহুদিন হলো সে বংশ লোপ পাইয়াছে

এসব বলে শেষে নরেন্দ্রনাথের ভাষ্য এমন: গোপালের বংশ লোপ পেলেও তিনি তাঁর ভাই কল্যাণের নবম অধস্তন পুরুষ

খটকার রাজ্য ও গোপাল

গোপাল সম্বন্ধে এটুকু জানার মধ্য দিয়ে সব মিটমাট হয়ে গেলে এবং নরেন্দ্রনাথ মহাশয়কে এককথায় গোপালের বংশধর মেনে নিলে কথা ছিল নাকিন্তু খটকা পিছু ছাড়ল না পণ্ডিতদেরতাঁরা বললেন, কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাসদ কবি ভারতচন্দ্র ও সংগীতজ্ঞ রামপ্রসাদ দুজনকেই জমি দান করেছিলেনগোপাল যদি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয়পাত্র ও ওই আমলের লোক হবেন, তবে নদীয়া বা কৃষ্ণনগরে তাঁর কোনো ভূসম্পদ থাকার প্রমাণ নেই কেন? এমনকি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহাফেজখানায় গোপালের অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো দালিলিক প্রমাণাদি নেইতাঁর কোনো ছবিও নেই

গোপালের অস্তিত্ব নিয়ে যাঁদের খটকা বেশি, তাঁরা আরও বেশি মাত্রায় যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন ভারতচন্দ্রের কাছ থেকেমধ্যযুগের বিশিষ্ট এই কবি অন্নদামঙ্গল কাব্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর সভাসদদের অনেকের সম্পর্কে লিখলেও লক্ষণীয়ভাবে এতে গোপাল ভাঁড় বিষয়ে টুঁ শব্দটিও নেইগোপাল যদি তাঁর সমসাময়িক এবং একই সভার সদস্য হতেন, তবে ভারতচন্দ্রের লেখায় তাঁকে পাওয়া যেতইএই তাঁদের ফয়সালা

খটকা আরও আছেগোপালের অনেক গল্পে তাঁর মা ও স্ত্রীর প্রসঙ্গ আছেকিন্তু গোপালের মা আর বউ সম্পর্কে ইতিহাস বিস্ময়করভাবে নীরবতাঁরা বেঁচে আছেন কেবল গল্পেই

ফলে নগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা নবদ্বীপ কাহিনী কিতাবটিকে গোপালের একক ব্যক্তি অস্তিত্বে সন্দিহান পণ্ডিতেরা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেনউপরন্তু প্রশ্ন তুলেছেন, গোপালের উত্তরাধিকারী বিষয়ে লেখকের দাবি নিয়েও: গোপালের বড় ভাই কল্যাণের বংশ-পদবি নাইহলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম নগেন্দ্রনাথের পদবি দাসকেন?

এ সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ নিরুত্তরতবে তাঁর বর্তমান প্রজন্মযাঁরা এখন বাস করছেন কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাধাপ্রসাদ লেনেতাঁদের বক্তব্য, ‘নরেন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর পারিবারিক পদবি পরিবর্তন করেছিলেন

বছর চারেক আগে (২০১৪) গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে নামে সুজিত রায় প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেননগেন্দ্রনাথ দাসের বর্তমান বংশধরদের বক্তব্য ওই বই থেকে উদ্ধৃতগোপাল ভাঁড় প্রসঙ্গে বইটিতে সুজিতের অনুসন্ধান বিস্তরবিভিন্নজনের বিচিত্র লেখাপত্রের সঙ্গে ইতিহাসকে মিলিয়ে তিনি গোটা পুস্তকে খুঁজেছেন হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ববলা ভালো, নানা রকম প্রশ্ন ও যুক্তি খণ্ডন করে গোপালকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত করার দিকেই তাঁর বেশি ঝোঁকএ ক্ষেত্রে ওপরে লিপিবদ্ধ খটকাগুলোর জবাবও দিয়েছেন তিনি

গোপালের ভূসম্পত্তির সন্ধান না পাওয়া বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘গোপাল সম্ভবত হাত পাততে জানতেন নাহয়তো সে কারণেই গোপাল মহারাজার দাক্ষিণ্য বঞ্চিত হয়েছেনতা ছাড়া বলার মতো একটি তথ্য আছে বইয়ে: রমেশ-উমেশের মৃত্যুর মাধ্যমে যেহেতু গোপালের প্রত্যক্ষ বংশধারা লুপ্ত হয়ে যায়সুতরাং জমিজায়গার নথিপত্র তারপর কি হয়েছে কে বলতে পারে!একইভাবে ভারতচন্দ্রের লেখায় গোপালের উল্লেখ না থাকা নিয়ে তাঁর পাল্টা যুক্তি, ঈর্ষা আর আত্মপ্রচারের বাগাড়ম্বরে তিনি (ভারতচন্দ্র) গোপাল ভাঁড়ের মতো বিরল প্রতিভাকে নিঃশব্দে বর্জন করেছেন

গোপাল ভাঁড়ের সন্ধান করতে গিয়ে সুজিত রায়ের কিছু কথায় যুক্তির জোর আছে সন্দেহ নেই; তবে গায়ের জোরও যে আছে!

গোপাল ভাঁড় নস্যাৎ হয়ে গেছেন?

সত্যি সত্যিই গোপাল ভাঁড় নেই! সুকুমার সেনের মত আমলে নিলে ঘটনাটি তেমনই দাঁড়ায়, ‘গোপাল ভাঁড় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক ছিলেন, এই আধুনিক জনশ্রুতি এখন প্রায় ঐতিহাসিক সত্য বলে গৃহীত হতে চলেছেকিন্তু সত্য কথা বলতে কি সত্তর-আশি বছর আগে জনশ্রুতিতে কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ গোপাল ভাঁড়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না’ (‘গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে’, হোমশিখা, ১৩৬১)কিন্তু সেকালের বিখ্যাত এই ইতিহাসবিদের কথাগুলো একেবারেই মানতে চায় না মনবরং বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো মনে হয় তখন, যখন একালের আলোচিত ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রও একই সুরে কথা বলেনবলেন যে গোপাল ভাঁড় শহুরে লোকসংস্কৃতির সৃষ্টি। (দ্য টেলিগ্রাফ, ১১ মে ২০১৪)বাঙালির আদরের এই ধনটি তাহলে বাস্তবে নেই? গোপাল ভাঁড় নস্যাৎ হয়ে গেছেন? অগত্যা এ বিষয়ে আরেক প্রস্থ ঘাঁটাঘাঁটি করতেই হয়গোপালকে নিয়ে আরও যেসব বিষয়-আশয় মাথার মধ্যে গোলমাল পাকায়, সেগুলো তাঁর জাতি, বাসস্থান, পড়ালেখা, পদবি প্রভৃতি তথ্যের বিভিন্নতা

জাতিতে নাপিত’-এর বিপরীতে কোনো কোনো গবেষক গোপালকে কায়স্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছেনঅনেকের মতে, তিনি বাস করতেন কৃষ্ণনগরেবাঙ্গালা ক্ষিতীশ বংশালী গ্রন্থের ভাষ্য, গোপাল ছিলেন শান্তিপুরের বাসিন্দাকথিত আছে, তাঁর বাড়ি ছিল ঘূর্ণীতেআবার নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষ-এপাওয়া যাচ্ছে, গোপালের বাড়ি গুপ্তিপাড়াকারও ভাষায়, তিনি পড়ালেখা জানতেনকেউ বলেছেন, জানতেন নাআর এই মহাত্মার পদবি নিয়েও আছে যথেষ্ট ধন্দনাই, বিশ্বাস, হাস্যার্ণব, ভান্ডারি, ভাঁড়তবে কোনটি সঠিক?

শুধু তথ্যের পর তথ্যকিন্তু মজার ব্যাপার হলো, গোপালের বিয়ে ও মৃত্যু নিয়ে ইতিহাস ভীষণ চুপচাপতো, বহুচর্চিত এই রসিক সম্বন্ধে ইতিহাসের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম কী বলেছেন, এবার টুকে নেওয়া যাক সেটুকু, ‘কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দেহরক্ষক হিসেবে শঙ্কর তরঙ্গ নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।...হয়তো তিনিই পরবর্তীকালে গোপাল ভাঁড় হিসেবে কল্পিত হয়েছেন’ (বাংলাপিডিয়া)

ধন্দের পর ধন্দমুশকিল আসানের কোনো বার্তা নেই

গোপাল ভাঁড় আছেন

বাস্তব চরিত্রের শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে গোপাল ভাঁড়ের আকারে-গড়নে বেশ খানিকটা খামতি হয়তো আছে, সে ক্ষেত্রে তিনি সামষ্টিক মানুষের কল্পিত কোনো অবয়ব, না বাস্তব একটি চরিত্রএ বিতর্ক অনিঃশেষগোপাল ভাঁড় কোনো বই লেখেননিতাঁর প্রতিটি গল্পই মানুষের মুখে মুখে ঘুরে জনপ্রিয় হয়েছেতাই মৌখিক সাহিত্য যে প্রক্রিয়ায় বাহিত হয়কোনো ব্যক্তি যখন চমকপ্রদ কোনো গল্প শোনেন, তাঁর মধ্যে সেই গল্পটি পুনরায় বলার ইচ্ছা তৈরি হয় এবং পুনঃকথনকালে তাঁর অজান্তেই গল্পটি কিছুটা বদলে যায়এভাবেই কি গোপাল জনমানসে পৌঁছেছেন? অলোক কুমার চক্রবর্তী তো বলেছেনই, ‘নদীয়ার হাস্যরসিক মানুষই কাল্পনিক হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের সৃষ্টিকর্তাহয়তো গোপাল ভাঁড়এই ছদ্মনামের অন্তরালে তাঁরা তাঁদের হাস্যরস প্রকাশ করেছেন’ (‘গোপাল ভাঁড়: কল্পনা বনাম বাস্তব’, দৈনিক বসুমতী, ১৯৮২) এই কথায় অতঃপর শান্তি আসে, ধড়ে পানি আসেশেষ পর্যন্ত তাহলে গোপাল ভাঁড় আছেনরয়েছেন নিম্নবর্গের বাঙালির প্রতিনিধি হয়ে, তাঁদের হাস্যরসে, দুঃখেওএই বাংলার সামন্ততান্ত্রিক সমাজে একদা যখন ছিল নগরসভ্যতার উন্মেষকাল, তিনি ছিলেন সেই সমাজের রাজনৈতিক চেতনাবিবেকআর গোপালের রাজনৈতিক চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছিল ভাঁড়ামির ছদ্মবেশেকিন্তু বিবেক গোপাল কি শুধুই ভাঁড়?

তাঁরই একটি গল্পের ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রশ্নটির উত্তর

কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে একবার বললেন, ‘আমি সত্য-মিথ্যার মধ্যে দূরত্ব অনুমান করতে পারছি নাএ ব্যাপারে তুমি আমাকে একটু সাহায্য করলে ভালো হয়

গোপাল বললেন, ‘এ আর এমন কী কঠিন সমস্যা, মহারাজ! চোখ আর কানের মধ্যে যতটা দূরত্ব, সত্য ও মিথ্যার মধ্যেও ততটা

গোপালের কথার মাজেজা বুঝলেন না কৃষ্ণচন্দ্রবললেন, ‘বুঝিয়ে বলোআমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না

এবার গোপাল বললেন, ‘মহারাজ, যা শুনবেন, তা যদি চাক্ষুষ প্রমাণ করতে পারেন, তবে তা-ই হলো সত্যিআর কানে শুনলেন, চোখে দেখলেন না, এটা কখনো সত্যি নয়সে জন্যই সত্য-মিথ্যার সঙ্গে চোখ-কানের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং চোখ-কানের মধ্যে দূরত্ব যতটা, সত্য-মিথ্যারও দূরত্ব ততটা


এরপর ভাঁড়ামি অর্থে গোপালকে শুধু ভাঁড়বলে পার পেয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ হবে!


শেয়ার করুন

0 facebook: