তাসলিমা নাসরিনঃ আমি
আর আমার নানি আমার মা’র
অসুখের সময় সারাক্ষণ পাশে ছিলাম। আমরা দু’জনই দিন রাত মা’র
যত্ন করেছি। অন্য কেউ পাশে আসেনি তেমন। বাড়ির পুরুষেরা ব্যস্ত ছিল নিজেদের নিয়ে। কিন্তু
মা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা’র
মৃতদেহটি নিয়ে কী কী করতে হবে,
তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল পুরুষেরা। মা’কে
খাটিয়ায় শুইয়ে নিয়ে গেলো জানাজায়,
কবরস্থানে। আমি যেতে চাইলাম সঙ্গে, আমাকে
বলা হলো, না
জানাজায়-না কবরস্থানে,
কোথাও মেয়েদের যাওয়ার অনুমতি নেই। পুরুষেরা মোটামুটি যা বললো, তা
হলো, আমি
আমার মা’র
সন্তান হতে পারি, কিন্তু
জানাজায় আমার মায়ের লাশের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার কোনও অধিকার নেই, জানাজা
পড়ার কোনও অধিকার আমার নেই,
মায়ের কবরে মাটি দেওয়ার অধিকার নেই, কবরস্থানে
ঢোকার অধিকারই নেই। কেন নেই?
নেই,
কারণ আমি মেয়ে। ইসলাম ধর্ম মেয়েদের বারণ করেছে জানাজায় বা
কবরস্থানে যেতে।
বাংলাদেশে কোনও জানাজার
নামাজে কোনও মেয়ের উপস্থিতি নেই। কিন্তু পাকিস্তানে আছে, সম্ভবত
আরও কিছু মুসলিম দেশে আছে। এই সেদিন পাকিস্তানে মানবাধিকারের জন্য লড়াই করার
আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গীরের জানাজা হলো, ওই জানাজায় অংশ নিয়েছে প্রচুর মেয়ে, সামনের
সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছে আসমা জাহাঙ্গিরের কন্যাসহ কয়েকজন মেয়ে। ইসলাম কি তাহলে
সম্মতি দেয় মেয়েদের জানাজায় অংশগ্রহণের? উত্তর যা পেয়েছি, তা
হলো, অনুমতি
দেয় না, বারণ
করে, নামাজ
মেয়েদের জন্য ঘরে বসে পড়াই উত্তম বলে বিবেচনা করে। কিন্তু জানাজার নামাজ যদি পড়েই
মেয়েরা, তা
বেআইনি নয়, ইসলাম
বিরোধী নয়। তবে যদি পড়তেই চায়,
পুরুষদের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। কিছুতেই সামনে নয়।
কেউ কেউ বলে আরব দেশে
মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবীর আমলে মেয়েরাও অংশ নিত জানাজায়। তখন
নিশ্চয়ই তাদেরকে পেছনের কাতারে দাঁড়াতে হতো। আজ ১৪০০ বছর পর, মেয়েদের
অধিকার আগের চেয়ে বাড়ার কথা অনেক,
অথচ বাংলাদেশে জানাজার সামনের কাতারে তো প্রশ্নই ওঠে না, পেছনের
কাতারেও মেয়েরা অনুমতি পায় না দাঁড়ানোর।
পাকিস্তান যেটা পারে, বাংলাদেশ
সেটা পারে না কেন? পাকিস্তানের
জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে,
বাংলাদেশের জন্ম ভাষা, সংস্কৃতি আর ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে। পাকিস্তান
এবং বাংলাদেশের দুই ভিত্তিতে আকাশ পাতাল তফাত। অথচ পাকিস্তানের মতো ধর্মে ডুবে
থাকা দেশেও মেয়েরা স্বাধীনতা আর অধিকার যতটুকু পায়, বাংলাদেশে তা পায় না। আমি দাবি করছি না, পাকিস্তানের
মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে না। হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা নির্যাতিত তো হচ্ছেই, তার
ওপর নিজের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। যে যৎসামান্য অধিকার ইসলাম তাদের দিয়েছে, সেটুকুও
তাদের ভোগ করা হচ্ছে না। জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করার অধিকার আছে মেয়েদের, অথচ
বাংলাদেশের মেয়েদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ভারতের কেরালা রাজ্যের
মালাপ্পুরামে ওয়ান্দুর চেরুকোড় গ্রামে গত মাসে জামিদা বিবি নামের এক মেয়ে জুম্মার
নামাজের ইমামতি করেছেন। ইসলাম হয়তো মেনে
নিতে পারে যে মেয়েরা মেয়েদের নামজের ইমাম হচ্ছে, কিন্তু পুরুষেরা মেয়েদের পেছনে দাঁড়িয়ে
নামাজে পড়বে, এ
অসম্ভব। এই অসম্ভব কাণ্ডটি একটি গ্রামের মেয়েটি ঘটিয়ে দিয়েছেন। নারী পুরুষ উভয়ে
জামিদা বিবির পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন। নামাজ শেষের খুতবায় জামিদা নারী পুরুষের
সমানাধিকারের কথা বলেছেন। বলেছেন,
‘কোরানে নারী পুরুষের সমতার কথা লেখা আছে, কিন্তু
বৈষম্যগুলো সৃষ্টি করেছে মানুষ,
এই বৈষম্য আমি দূর করবো’। জামিদা বলেছেন, ‘কোরানের
কোথাও লেখা নেই যে পুরুষদেরই সবসময় ইমামতি করতে হবে’। জামিদা কোরানে বিশ্বাস করেন, হাদিসে
নয়, কারণ, তার
যুক্তি, হাদিস
আল্লাহ বা রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লেখেননি। হাদিস লিখেছেন রসুলের
অনুসারিরা। অনুসারিদের ওপর জামিদার আস্থা নেই। দীর্ঘ ১৪০০ বছর যাবৎ পুরুষেরাই
সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মুসলমানদের সব ব্যাপারে, এই নিয়মের বদল চান জামিদা। জামিদা বিবি
মসজিদে নামাজ পড়ান না, পড়ান
তার কুরআন সুন্নত সোসাইটির অফিসে। এই নামাজের খবর শুনে মুসলমানদের রাজনৈতিক দল ‘জামাতে
ইসলামি হিন্দ’-এর
সেক্রেটারি আব্দুল রহমান বলেছেন,
‘জামিদা বিবি যা করছে, তা জাস্ট ড্রামা’। ফতোয়া
জারি হয়েছে জামিদা বিবির বিরুদ্ধে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী নন জামিদা। তিনি
বলেছেন ইমামতি তিনি করেই যাবেন,
ফতোয়া জারি হলে হোক। প্রয়োজনে পুলিশি নিরাপত্তা নেবেন। জামিদা
বিবি আরও বলেছেন, ‘ভারতের
মতো দেশ সামনে কী করে এগোবে,
যদি মেয়েদের দাবিয়ে রাখার নিয়মগুলো না বদল করা হয়?’ জামিদা
বিবির মতো সাহসী মেয়ে বাংলাদেশে নেই কেন? বা
অন্যান্য মুসলিম দেশে নেই কেন?
বাংলাদেশে এখনও মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে মেয়েদের বাধা দেওয়া হয়।
অনেক মুসলিম দেশেই
মেয়েরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েদের পায়ে পায়ে শেকল। এখানে
যত বাধা, তত
বাধা অন্য কোথাও নেই। কোনও কোনও মসজিদের
ভেতর পুরুষের নামাজের এলাকা থেকে দূরে, দেয়ালের ওপারে আলাদা জায়গায়, কখনও
কখনও মেয়েরা নামাজ পড়েন বটে,
তবে প্রায় সব মসজিদে বড় বড় অক্ষরে নোটিশ টানিয়ে রাখা হয়েছে, ‘মেয়েদের
প্রবেশ নিষেধ’।
মুসলমান পুরুষদের কাছে মেয়েরা হলো অস্পৃশ্য। অন্ধকার যুগে বর্বররাও বলতো, মসজিদে
গিয়ে মেয়েরা নামাজ পড়তেই পারেন,
তবে ভালো হয় তাঁরা যদি ঘরে বসে নামাজ পড়েন। ওদিকে আবার এটাও
বলা আছে, জামাতে
নামাজ পড়লে সওয়াব বেশি। তাহলে মেয়েদের জামাতের সওয়াব নিতে দেওয়া হবে না কেন? মেয়েরা
যদি বাংলাদেশের সব মসজিদেই ঢুকতে চান, তবে তাদের ইসলামের কোন আইনে বাধা দেওয়া
হয়?
কোনও মসজিদের আইনত কোনও
অধিকার নেই মেয়েদের মসজিদে যেতে বাধা দেওয়ার। প্রতিটি মসজিদে মেয়েদের নামাজ পড়তে
দেওয়া হোক। মেয়েরা নামাজ পড়লে ইমামরা এই যে প্রতিদিন তাদের খুতবায় নারীর বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষায় কথা বলেন, তা
অন্তত বন্ধ হওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে।
ইসলামে মেয়েদের সম্পর্কে
অনেক উপদেশ আছে, যা
স্পষ্ট নয়। কোনও হাদিস বলেছে,
মেয়েরা শিক্ষা নিতে সুদূর চীন দেশে যেতে পারে, কোনও
হাদিস বলেছে, মেয়েরা
খবরদার ঘর থেকে এক পা-ও বেরিয়ো না। এইসব দু’রকমের বক্তব্য মানুষকে ধন্দে ফেলে।
যুগের সঙ্গে তাল যে
মেলাচ্ছে না মুসলমানেরা তা কিন্তু নয়, শুধু মেয়েদের অধিকারের সামনেই দাঁড়িয়ে
আছে খড়্গহস্ত। মেয়েদের সমানাধিকারের কথা কুরআন হাদিসে নেই। মোবাইল ফোন, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক
ব্যবহারের কথাও তো কুরআন হাদিসে নেই। অথচ এগুলো দেদার ব্যবহার করছে মুসলমানেরা। কুরআন
হাদিসে বরং লেখা আছে, বিধর্মীর
সঙ্গে বন্ধুত্ব না করতে। অথচ বিধর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছাড়া জীবন অচল আজকাল। বিধর্মীদের
আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মুসলমানেরা। বিধর্মীকে শত্রু ভাবলে, তাদের
আবিষ্কৃত বিজ্ঞান বর্জন করলে আধুনিক জীবন যাপন বাদ দিয়ে প্রাচীন জগতে অথবা অন্ধকার
যুগে ফিরে যেতে হবে মুসলমানদের। বিধর্মীদের সঙ্গে শত্রুতা না করা, বরং
বন্ধুতা করা আধুনিক হওয়ার বা সভ্য হওয়ার
ছোট একটি পদক্ষেপ মাত্র।
আজ কেরালার গ্রামের একটি
মেয়ে যদি ইমামতি করতে পারেন,
তবে মুসলিম সমাজের আর মেয়েরা পারবেন না কেন? শুধু
মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার অধিকার নয়,
মেয়েদের ইমামতি করার অধিকারও চাই। ইসলাম সাম্যের কথা বলে– এটি
শুনতে শুনতে কান পচে গেলো। এইবার দেখতে চাই সত্যি সত্যি যে ইসলাম সাম্যের কথা বলে।
সপ্তম শতাব্দির ইসলামকে একবিংশ শতাব্দির ইসলামে পরিণত করতে হবে, যে
ইসলাম মেয়েদের মসজিদে নামাজ পড়া,
মেয়েদের ইমামতি করা– কোনোটিতে বাধা দেয় না।
খবর বিভাগঃ
আন্তর্জাতিক
ধর্মীয় বিদ্বেষ
0 facebook: